বিলাইছড়িঃ ধুপপানি ঝর্ণার দেশে (শেষ পর্ব)

দ্বিতীয় পর্বের পর 

ভোর পাঁচটা; কার যেন অ্যালার্ম বেজেই চলছে একস্বরে! ধড়াম করে জেগে উঠলাম, জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি আলো ফুটতে শুরু করেছে সবে। আজ যে ঝর্ণায় যাত্রা, তাতে পৌঁছুতে অন্যান্য ঝর্ণার চেয়ে সবথেকে বেশি সময় লাগবে। তাছাড়া আজ রাতে ঘরে ফিরবার পরিকল্পনাও করতে হবে। তাই সবাইকে এখনই না জাগিয়ে দিতে পারলে পুরো দিনে ধুপপানি ঝর্ণা দেখে বাড়ি ফেরা হয়তো সম্ভব হবে না।

। দ্রুত চা পর্ব শেষে উঠে পড়তে হবে নৌকায় ।
। দ্রুত চা পর্ব শেষে উঠে পড়তে হবে নৌকায় । ছবি: নিশান আহমেদ ।

ঘুম থেকে উঠে মুখ-হাত ধুয়ে, দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে সবাই যে যার রুম ত্যাগ করতে গিয়ে দেখি ঘড়ির ছোট মাথাটা ছয়টার কাঁটায় পা রাখবে-রাখবে করছে। সকালের নাস্তার ব্যাপারটা আগে থেকেই খাওয়ার হোটেলে বলে রেখেছিলাম, তাই প্যাকেট ভর্তি ডিম খিচুড়ি তোলা হলো নৌকায়। ভেবেছিলাম শরীরটাকে একটু চাঙ্গা করে নিবো; ক’ কাপ চায়ের কথা বলতে না বলতেই মনসুর ভাই এমন তাড়া দেয়া শুরু করলেন যে, জিভ পুড়ে কেউ কয়েক চুমুক পড়িমড়ি করে খেয়ে; কেউবা না খেয়েই বিল মিটিয়ে হাঁটা দিলাম নৌকার উদ্দেশ্যে। ব্যাগসমেত নৌকায় উঠে ফিরে তাকালাম বিলাইছড়ির এ ঘাট বরাবর বেঁকে যাওয়া উঁচু রাস্তাটার দিকে। এক রাতেই কেমন স্মৃতি জমিয়ে ফেলেছিলাম সবাই। কেমন যেন আপন করে নিয়েছিলো এ জায়গাটা। নৌকার ইঞ্জিনের শব্দ কানে তালা লাগানোর আগেই সোজা উপরের পাটাতনে উঠে গেলাম, আর বিদায় জানালাম বিলাইছড়ির হাসপাতাল ঘাটকে। খারাপ লাগছিলো ভীষণ, বিলাইছড়ি ভ্রমণের শেষদিন আজ।

। জীবিকার তাগিদে আলো ফুটবার আগেই নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন স্থানীয়রা । ছবি: আল আদনান সামি ।
। জীবিকার তাগিদে আলো ফুটবার আগেই নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন স্থানীয়রা । ছবি: আল আদনান সামি ।

গন্তব্য এবার উলুছড়ি। মাঝি ভাই জানালেন প্রায় দেড় থেকে দুই ঘন্টা নৌকায় যাত্রার মানসিক প্রস্তুতি নিতে। রোদ না ছোঁয়ার আগেই সকালের এসময়টা সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগলো আমার। জীবিকার সন্ধানে এতো সকালেই ছোট ডিঙ্গি নৌকায় চেপে দূর দূরান্তে মিলিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয়রা। যা বুঝলাম: এখানকার বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা নির্বাহ এবং জীবিকার জন্য যাত্রার কেন্দ্রবিন্দু এই কাপ্তাই লেক। সময় করে সবাই নৌকার উপরের পাটাতনে গোল হয়ে বসে নাস্তাটা সেরে নিলাম। আবারও সেই গান, আড্ডাকেই সময় কাটানোর উৎস হিসেবে  নিতে হলো। তবে কিছুক্ষণ পর-পরই চোখ চলে যাচ্ছিলো পাহাড়ঘেরা মেঘের সাথে আকশের দৃশ্যমান সখ্যতার দিকে!

। চোখ চলে যাচ্ছিলো পাহাড়ঘেরা মেঘের সাথে আকাশের দৃশ্যমান সখ্যতার দিকে । ছবিঃ আল আদনান সামি ।
। চোখ চলে যাচ্ছিলো পাহাড়ঘেরা মেঘের সাথে আকাশের দৃশ্যমান সখ্যতার দিকে । ছবিঃ আল আদনান সামি ।

‘দীঘলছড়ি আর্মি ক্যাম্পে’ প্রান্ত আর মেজবাহ আমাদের প্রত্যেকের জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মসনদের ফটোকপি নিয়ে নামলো। এবারে আমাদের আর নামতে হলো না, গাছকাটা আর্মি ক্যাম্পে তোলা ১৭ জনের ছবি দেখিয়েই পার পাওয়া গেলো। তবে সময় বেঁধে দিলো বিকাল পাঁচটা, এবং ফিরতি পথে হাজিরা দিয়ে যাওয়ার। এরই মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে রোদ উঠতে শুরু করলো। এ গরমে পাটাতনে বসে থাকা যাচ্ছে না, গা যেন পুড়ে যায় মতন অবস্থা! তবে নৌকা ছাড়া মাত্রই গায়ে বাতাস লাগছিলো। একদিকে কড়া রোদ, অন্যদিকে নৌকার জোরালো বেগে তৈরি হওয়া ঢেউ খেলানো বাতাস; বুঝলাম কেবল পাটাতনেই আরামে বসা যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো চোখজোড়াকে নিয়ে; কোনোভাবেই চোখ মেলে রাখা যায় না। গামছা,শাল- যে যা পারলো তাই চোখের উপর দিয়ে রোদের হিংসুক আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করছিলো। কেউবা আবার রোদ থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিচ্ছিলো নৌকোর নিচের অংশটায়, সহ্য করে নিচ্ছিলো ইঞ্জিনের মাথা ধরিয়ে দেয়া শব্দ।

। রোদের আক্রমণ থেকে নিজেদের চোখ বাঁচানোর চেষ্টা ।  ছবি: নিশান আহমেদ ।
। রোদের আক্রমণ থেকে নিজেদের চোখ বাঁচানোর চেষ্টা । ছবি: নিশান আহমেদ ।

দেড়ঘন্টা পর নৌকা আরেকটি আর্মি ক্যাম্পে থামলো, এখানেও সেই একইভাবে আমাদের প্রত্যেকের জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মসনদের ফটোকপি নিয়ে নামতে হলো দুজনকে। জানতে পারলাম, এখানেও বিকাল পাঁচটার মধ্যেই এ আর্মি ক্যাম্পে এসে চেক আউট করতে হবে। আমাদের পাশে আরেকটা নৌকায় দেখলাম এক আদিবাসী পরিবারকে, সম্ভবত তারাও ভ্রমণে বেড়িয়েছেন। নয়টা পেরিয়ে যাবার কিছু আগে এসে পৌঁছুলাম উলুছড়ি। আমরা একে একে নামতে লাগলাম নৌকা থেকে। মনসুর ভাই (মাঝি) একজন গাইড দাদাকে ঠিক করে দিলেন ৫০০ টাকায়। যাওয়ার আগে মাঝি ভাই জানালেন এখানেই দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভব। জিজ্ঞেস করলেন: পাহাড়ী দেশী মুরগী, ভাত আর আলুর ভর্তায় চলবে নাকি আমাদের? আমরা খুশিমনেই দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে বললাম।

। আমাদের পাশে আরেকটা নৌকায় দেখলাম এক আদিবাসী পরিবারকে, সম্ভবত তারাও ভ্রমণে বেড়িয়েছেন । ছবিঃ আল আদনান সামি ।
। আমাদের পাশে আরেকটা নৌকায় দেখলাম এক আদিবাসী পরিবারকে, সম্ভবত তারাও ভ্রমণে বেড়িয়েছেন । ছবিঃ আল আদনান সামি ।

উলুছড়ির এই বোট পয়েন্টে কিছু ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকার দেখা পেলাম। জানলাম, এমন নৌকায় করেই আরও ১৫-২০ মিনিটের জলপথ অতিক্রম করতে হবে আমাদের। প্রতি নৌকায় ৫-৬ জনের বেশি উঠা সম্ভব না। যথেষ্টই নড়বড়ে ও ছোট নৌকা, তবে ইঞ্জিনের বিকট শব্দ শুনতে হবে না ভেবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম অবশেষে। ৩ টি নৌকায় উঠে পড়লাম আমরা, প্রতি নৌকা ভাড়াবাবদ ৩০০ টাকা করে নিবে। ভাগ-ভাগ করে নৌকায় উঠে পড়লাম সবাই। প্রচন্ড রোদ, তার মাঝে মৃদু বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের শরীর। বৈঠা আর পানির নির্দিষ্ট সময় পরপর স্পর্শে আলাদা সুর-তান তৈরি হচ্ছে। নৌকা যতো এগুচ্ছে ততোই দেখা যাচ্ছে জলাভূমির বড় বড় জঙলা মতন শ্যাওলা-সবুজ গাছগুলি। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় জল। একটু দূর যেতেই চোখে পড়লো শত-সহস্র শাপলা ফুল। মুষ্টি করলেই গুচ্ছখানেক শাপলা চলে আসবে হাতে। সাড়ে নয়টা কি দশটা বাজে শুরু হলো আমাদের মূল ট্রেকিং।

। রাঙামাটির সবচেয়ে সুন্দর ঝর্ণা এটি, নাম ধুপপানি ঝর্ণা । ছবি: নিশান আহমেদ ।
। রাঙামাটির সবচেয়ে সুন্দর ঝর্ণা এটি, নাম ধুপপানি ঝর্ণা । ছবি: নিশান আহমেদ ।

সাড়ে নয়টা কি দশটা বাজে শুরু হলো আমাদের মূল ট্রেকিং। গাইড দাদা জানালেন, কমপক্ষে ২ ঘন্টা তো লাগবেই ঝর্ণায় পৌঁছুতে। রাঙামাটির সবচেয়ে সুন্দর ঝর্ণা এটি, নাম ধুপপানি ঝর্ণা।

লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এ ঝর্নাটি ২০০০ সালে ধ্যানমগ্ন এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কল্যাণে সকলের মাঝে পরিচিতি লাভ করে। মূলত স্থানীয়রা ঐ সন্ন্যাসীকে সেবা দিতে গিয়েই এ ঝর্ণার সন্ধান পায়। প্রায় ১৫০ মিটার উপর থেকে এর জল আছড়ে পড়ে সমতলে, তাই এ পানির রঙ দেখা যায় প্রায় দুধ-সাদা। তঞ্চঙ্গা ভাষায় তাই ধুপপানির আরেক নাম ‘সাদা পানি।’ এ ঝর্নার নিচে, প্রায় সমতল ঘেঁষে, একটি গুহা আছে যার ভিতরে বসে ঝর্ণা উপভোগ করা যায় একদম কাছ থেকে।

। ক্ষেতের মাঝ দিয়ে হাঁটছিলাম, চোখে পড়ছিলো স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বাড়ি । ছবি: নিশান আহমেদ ।
। ক্ষেতের মাঝ দিয়ে হাঁটছিলাম, চোখে পড়ছিলো স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বাড়ি ।  ছবি: নিশান আহমেদ ।

আমরা হাঁটা শুরু করলাম ক্ষেতের মাঝ দিয়ে। কখনো বা তা সরু থেকে সরু হয়ে একটা ছোট রাস্তায় তৈরী হয়। স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং অদূরে তাদের বাড়িগুলোও চোখে পড়ছিলো। কিছু রাস্তায় লম্বা জংলা ঘাসের দেখা পেলাম দু’ পাশে, আবার কোথাও একপাশে বন অন্যপাশে জল। তবে কিছুক্ষণ পর-পরই ঝিরির ছোট ছোট জলপথ অতিক্রম করতে হচ্ছিলো। বেশ খানিকক্ষণ রগরগে রৌদ্রস্পর্শে পা চালিয়ে হাঁটায় যে ক্লান্তি নামছিলো, ঝিরির জল পায়ে লাগতেই শীতলতা ছড়িয়ে দিচ্ছিলো পুরো শরীরে। গামছায় জল ভরে, চিপে শরীরকেও শীতল করার চেষ্টা করতে লাগলাম থেমে থেমে। একসময় সামনে পড়লো একটা সাঁকো, পার হলাম ভয়ে ভয়ে। সাঁকো পারাপারে আমরা কেউ কেউ নিতান্তই আনাড়ী।

। এবার যাত্রা ধুপপানি ঝর্ণার উদ্দেশ্যে ।  ছবি: নিশান আহমেদ ।
। এবার যাত্রা ধুপপানি ঝর্ণার উদ্দেশ্যে ।  ছবি: নিশান আহমেদ ।

একটা পাহাড়ের পথ ধরতে হলো। দুপাশে কলাগাছ, মাঝে সরু পথ চলে গেছে। কখনো পাহাড়ী রাস্তায় উপরে উঠছি, কখনো খানিক সমতলে হেঁটে আবারো কিছুটা নিচে নামছি। তবে যা বুঝলাম, বেশিরভাগ সময় উপরেই উঠা হচ্ছিলো। এ রাস্তাগুলো বেশ সুবিধাজনকই মনে হলো আমার কাছে। কারণ মাটি কেটে সিঁড়ির মতো করে ধাপ ধাপ তৈরী করা আছে বেশিরভাগ পথ জুড়ে। একটানা উপরে ওঠার সময় মনোযোগ দিচ্ছিলাম নিজের পায়ের দিকে, কারণ উচ্চতা দেখামাত্রই মানসিকভাবে হাঁপিয়ে উঠার সম্ভাবনা ছিল। কিছু কিছু জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছিলাম বেশি হাঁপিয়ে গেলে।  এরই মাঝে অদ্রিজা জানালো সে আর সামনে এগুতে পারবে না। তার ভীষণ শরীর খারাপ লাগছে, তার পক্ষে আর ট্রেকিং করা সম্ভব নয়। কিন্তু একলা তাকে কোথায়ই বা রেখে যাওয়া যায়! প্রান্ত দত্ত জানালো অদ্রিজার সাথে ও থেকে যাবে। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হলো না। কারণ ওরা ফিরতি পথ হয়তো চিনবে না। অবশেষে গাইড দাদাই ওখানকার এক পাড়ায় কথা বলে ওদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিয়ে আসলেন। অর্থাৎ আমরা ফেরার আগ পর্যন্ত ওরা ঐ পাড়াতেই থাকবে।

। ঝোপঝাড়ে ভরা সরু রাস্তা, গাছ দিয়ে তৈরি সাঁকো পারাপার, যার নিচ দিয়ে ঝিরির পানি বইতে দেখা যাচ্ছিলো ।  ছবি: নিশান আহমেদ ।
। ঝোপঝাড়ে ভরা সরু রাস্তা, গাছ দিয়ে তৈরি সাঁকো পারাপার, যার নিচ দিয়ে ঝিরির পানি বইতে দেখা যাচ্ছিল । ছবি: নিশান আহমেদ ।

একটা জায়গায় এসে দেখলাম পথ দু’ দিকে চলে গেলো, ডানদিকের পথ ধরতে বললেন গাইড দাদা। আবারো সেই একই ঝোপঝাড়ে ভরা সরু রাস্তা, মাঝেমাঝে গাছ দিয়ে তৈরি সাঁকো পারাপার, যার নিচ দিয়ে ঝিরির পানি বইতে দেখা যাচ্ছিলো। একটা সময় পাহাড় থেকে নেমে দেখলাম ঝিরিপথে হাজির। জানা গেলো, এবার কিছুটা পথ ঝিরিপথেই হাঁটতে হবে। ঝিরিপথের শীতল পানি দিয়ে শরীরের ঘাম ধুয়ে ফেললাম। কিছুদূর ঝিরিপথ হাঁটা শেষে, আবার আরেকটা পাহাড়ে ওঠা শুরু। বোঝা গেলো আগের ঝর্ণাগুলোর চেয়ে এ ঝর্ণায় ঝিরিপথের দেখা কমই পাবো, পাহাড়ই পেরুতে হবে বেশি। একপাশে ঘন বন, আর অন্য পাশটায় পাহাড় ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। সবুজ গাছগাছালিতে ভর্তি পাহাড়ের ঢালু দিকটা, অদূরে জুমঘর দেখা যাচ্ছে মাঝেমাঝে।

। অবশেষে দেখা মিললো ধুপপানি পাড়ার ।  ছবি: নিশান আহমেদ ।
। অবশেষে দেখা মিললো ধুপপানি পাড়ার । ছবি: নিশান আহমেদ ।

প্রায় ঘন্টা দেড়েক ফুসফুস আর পা জোড়া চালিয়ে আমরা ধুপপানি পাড়ার দেখা পেলাম। ছোটবড় ৩-৪ টি পাহাড় ডিঙ্গোতে হয়েছে এ পাড়ার দেখা পাওয়ার জন্য। পাড়ায় একটা চা-খাবারের দোকান দেখা মাত্রই সব ধপ করে যে যেখানে পারলো বসে পড়লো। বিস্কুট, ডিম সিদ্ধ, গ্লুকোজ আর চা দিয়ে ক্লান্তি তাড়াবার চেষ্টা চললো সমান তালে। দোকানময় ঘুরে বেড়াচ্ছিলো ছোট্ট একটা বেড়ালছানা।

। শারীরিক শক্তি এবং ক্ষুধা মেটানো‌র জন্যে সিদ্ধ ডিমই যখন শেষ ভরসা ।  ছবি: নিশান আহমেদ ।
। শারীরিক শক্তি এবং ক্ষুধা মেটানো‌র জন্যে সিদ্ধ ডিমই যখন শেষ ভরসা ।  ছবি: নিশান আহমেদ ।

এবার নামার পালা। পাহাড় বেয়ে নামা শুরু করলাম। এখানেও দেখলাম, মাটি কেটে কেটে সিঁড়ির ধাপ তৈরি করা আছে। তবে তার আগে খাড়া একটা ঢাল পেরুতে হবে খুব সাবধানে, নিজের সুবিধা মতো মাটিতে পা ফেলে ফেলে। পাহাড়ে উঠার চেয়ে নামার সময়টাই আমার কাছে বেশি বিপজ্জনক লাগে, তাই সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ করে নামতে লাগলাম। একটা সময় ঝর্ণার শব্দ পেলাম, গাইড দাদা জানালেন বেশ দূর থেকেই এ ঝর্ণার শব্দ কানে আসে।

। মাটি কেটে কেটে সিঁড়ির ধাপ তৈরি করা ।। ছবি: নিশান আহমেদ ।
। মাটি কেটে কেটে সিঁড়ির ধাপ তৈরি করা । ছবি: নিশান আহমেদ ।

অবশেষে ঝিরিপথের দেখা পেলাম। অনুমান মিথ্যে নয়, কয়েক মিনিট ঝিরিপথ ধরে ট্রেকিং করেই ঝর্ণার দেখা পেলাম। বিস্ময়াভূত হয়ে তাকিয়েই রইলাম খানিকক্ষণ। আসলেই বেশ উপর থেকে এ ঝর্ণার পানি নেমে আসছে, মোহনীয় কলতান কানকে প্রশান্তি দিয়ে যাচ্ছে। একটা বড় পাথর খুঁজে তাতে বিশ্রামের জন্য সবাই বসে পড়লাম। আড়াই ঘন্টার চড়াই-উৎড়াই শেষে অনিন্দ্য সুন্দর স্নিগ্ধ এই ঝর্ণার যখন দেখা পেলাম, আঙ্গুলে না ছুঁয়ে বরং চোখের তৃষ্ণা আগে মিটিয়ে নিলাম। প্রাণ ভরে দেখলাম অনেকটাক্ষণ।

। একটা বড় পাথর খুঁজে তাতে বিশ্রামের জন্য সবাই বসে পড়লাম । ছবিঃ আল আদনান সামি ।
। একটা বড় পাথর খুঁজে তাতে বিশ্রামের জন্য সবাই বসে পড়লাম । ছবিঃ আল আদনান সামি ।

ঝর্ণাটার কাছে ঘেঁষতে বেগ পেতে হলো- অপেক্ষা করতে হলো বেশ কিছুক্ষণ। পর্যটকে ভরা ছিলো গুহার ভেতরটা। অগভীর পানি ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে গেলাম ঝর্ণার কাছে, যতো কাছে যাচ্ছি প্রবলবেগে ছিঁটকে আসা ঝর্ণার পানি শরীরে এসে পড়ছিলো। গুহার কাছে গিয়ে বেশ অবাক হলাম। আকাশের অপ্সরাকে মর্ত্যে ধরা দিতে দেখলাম প্রথম বারের মতো! গুহার পাথরের গায়ে আর পানিতে তাকিয়ে থাকলেই মাঝে মাঝে ধরা দেয় এই রংধনু। বৃত্তাকার এই রংধনু চার কি পাঁচ রংয়ে রাঙ্গানো ছিলো। এই প্রথম পূর্ণরুপ দেখলাম আকাশের এই আশ্চর্যের। ঝর্ণার শুভ্র পানি আর রংধনুর রং, প্রকৃতির প্রকাশিত সবুজ অথবা পাহাড়ের এই বিশালতা সব কিছুই যেনো একে অপরের জন্য, সহস্রগুনে বাড়িয়ে দিচ্ছে মোহময়তা!

। প্রবলবেগে ছিঁটকে আসা ধুপপানি ঝর্ণার পানি শরীরে এসে পড়ছিলো । ছবি: নিশান আহমেদ ।
। প্রবলবেগে ছিঁটকে আসা ধুপপানি ঝর্ণার পানি শরীরে এসে পড়ছিলো । ছবি: নিশান আহমেদ ।

গুহা থেকে যখন বের হলাম, মন তখন তৃপ্ত। এবার রওনা দিতে হবে। অথচ একদমই মন চাইছে না এ সময়টাকে চোখের আড়াল করতে। সময় যেহেতু বহমান, তাই ফেরার পথ ধরতেই হবে।

। আদিবাসী মানুষের জীবনযাত্রা ।  ছবি: আল আদনান সামি ।
। আদিবাসী মানুষের জীবনযাত্রা । ছবি: আল আদনান সামি ।

যে পাড়াটায় অদ্রিজারা রয়ে গিয়েছিলো, সেই পাড়াটায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে বিকেলের শুরু। খোঁজ নিয়ে জানলাম, একটু অপেক্ষা করতে হবে, পাড়া বেড়াতে গিয়েছে অদ্রিজা । পরে ফিরার পথে গল্প শুনলাম অদ্রিজার কাছ থেকে, গত চার-পাঁচ  ঘন্টায় কি করেছিলো তারা। অদ্রিজার ভাষায়, “শারিরীক অসুস্থতার কারণে ধুপপানি ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হবো ভেবে প্রথমে মন খারাপ হচ্ছিল। আবার এক অপরিচিত পাহাড়ি বাড়িতে থাকতে হবে প্রায় চার -পাঁচ ঘন্টার মতন, তারা কিভাবে নিবে আমাদের; এসব ভেবে অস্বস্তিও হচ্ছিল প্রথম দিকে। কিন্তু যখন ঐ বাড়িতে গেলাম, বাড়ির গৃহস্থ এবং ওনার মেয়েদের ব্যবহার এতটাই আন্তরিক ছিল যে আমি ভুলেই গেলাম আমি ওদের অচেনা কেউ। আমার ভাব হয়ে গেলো দুই পাহাড়ি কন্যা শান্তনা এবং শ্যামার সাথে। ওদের সাথে গল্প করতে করতে ওদের জীবন নিয়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। এক পর্যায়ে শ্যামা বলে উঠল, ‘দিদি চলেন, আপনাকে আমাদের গ্রামটা ঘুরে দেখাই এবং পাশেই একটা ঝর্ণা আছে ওটাতে নিয়ে যাই আপনাকে।’  আমি এক মুহূর্তও না ভেবে রাজি হয়ে গেলাম। শ্যামা এবং শান্তনা মিলে আমাকে পুরো গ্রাম টা ঘুরে দেখালো। তারপর নিয়ে গেলো ঝর্ণা দেখাতে। ও আচ্ছা, স্থানীয় ভাষায় ঝর্ণাটার নাম “বুয়াং”। বুয়াং এর স্বচ্ছ পানিতে গোসল করার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমরা ৩ জন মিলে ঝর্ণার স্বচ্ছ পানিতে গোসল, ঝাঁপাঝাপি, সাঁতার কাটলাম অনেকক্ষণ ধরে। তারপর যখন ফিরলাম তখন দেখি দলের বাকিরা সবাই চলে আসছে। ৪ ঘন্টার স্বপ্নের পৃথিবী থেকে বের হয়ে দলের আর সবার সাথে গন্তব্যের পথে হাঁটা ধরলাম, কিন্তু সেই মানুষগুলো আমার মনে গভীর দাগ কেটে ফেলেছিলো।”

। আদিবাসী মানুষের জীবনযাত্রা ।
। আদিবাসী মানুষের জীবনযাত্রা ।

নৌকায় ফিরলাম যখন, তখন বিকেল। নৌকায় উঠে জিরিয়ে নিলো সবাই, খাবার আনার জন্য মনসুর ভাই লোক পাঠিয়েছেন। হঠাত ঝুপ করে নৌকা থেকে পানিতে লাফ দিলো রাহাত, তার পরপরই মামুন। তারপর সজল, মুন্না, ফাহিম, প্রান্ত দত্ত সব গোসলে মেতে উঠলো। শুধু সাঁতারটা না জানার কারণে অসহায়ের মতো তাকিয়েই রইলাম, আর লেকের পানিতে ওদের ঝাঁপাঝাঁপি দেখতে লাগলাম।

খাবার চলে আসলো। প্রচন্ড ক্লান্ত ছিলাম, ক্ষুধাও ছিলো প্রচুর। ডিম সিদ্ধ, বিস্কুট আর পানি ছাড়া তেমন কিছুই পেটে যায়নি। দেশী মুরগীটা অসাধারণ লাগলো খেতে। খাওয়া শেষ হলে খাবারের টাকা পরিশোধ করে ফেরার পালা। নৌকা ছাড়লো। আমরা আবার সবাই উঠে পড়লাম নৌকার পাটাতনে। এবারে নৌকা চালাচ্ছে মুন্না। গতকাল থেকেই মনসুর ভাইয়ের পাশে বসে বসে ইঞ্জিনচালিত এ ধরনের নৌকা চালানোর কায়দা  শিখে ফেলেছে সে।

। পড়ন্ত বিকেল- ভ্রমণের বিদায় ঘন্টা বাজছে ।  ছবি: আল আদনান সামি ।
। পড়ন্ত বিকেল- ভ্রমণের বিদায় ঘন্টা বাজছে ।  ছবি: আল আদনান সামি ।

পড়ন্ত বিকেল। দুদিন আগে এমনই বিকেলেই উত্তেজনা ছিলো, প্রকৃতির একদম নিকটে পৌঁছানোর। আর এখন ফিরতে হবে শুধু পদচিহ্ন রেখে। মায়াময় ঘোলাটে সূর্য ডুবি ডুবি করছে, জানান দিচ্ছে: ভ্রমণের বিদায় ঘন্টা বাজছে। দুই আর্মি ক্যাম্পে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়ে নৌকা চলতে লাগলো। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে, চাঁদটা আকাশের এক কোণে হেলে পড়েছে ক্রমশ। মনমরা হয়ে সবাই উজ্জ্বল নক্ষত্র আর চাঁদের মোলায়েম আলো উপভোগ করছে। সজল গান ধরলো। একমুহূর্তে কাঞ্চনজঙ্ঘায় ফিরে গেলো যেন সবাই। ঘন্টা চারেক স্মৃতিকথনে কেটে গেলো যেন নিমেষেই।

। দুইদিনের জন্য নৌকাটাকে নিজের ঘর বানিয়ে ফেলেছিলাম সবাই ।
। দুইদিনের জন্য নৌকাটাকে নিজের ঘর বানিয়ে ফেলেছিলাম সবাই ।

কাপ্তাই ঘাটে পৌঁছুলাম সন্ধ্যা সাতটায়। ২ দিনের জন্য বড় নৌকাটা ভাড়া করেছিলাম ৬০০০ টাকায়। মনসুর ভাইকে টাকাটা বুঝিয়ে দিয়ে, নৌকা থেকে বিদায় নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। দুইদিনের জন্য নৌকাটাকে নিজের ঘর বানিয়ে ফেলেছিলাম সবাই। মনসুর ভাইয়ের সাথেও বেশ সখ্যতা তৈরী হয়ে গিয়েছিলো।

। জুমঘর ।
। জুমঘর ।

ইচ্ছে ছিল কাপ্তাই ঘাট থেকে বহদ্দারহাটের বাস ধরবো। কিন্তু সাতটার আগেই বহদ্দারহাটের শেষ বাস চলে গিয়েছে ততক্ষণে। অগত্যা জনপ্রতি ৪০ টাকা করে সিএনজিতে উঠে পড়লাম রাঙ্গুনিয়া লিচুবাগান পর্যন্ত যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সজল আর ফাহিম বিদায় নিলো রাঙ্গুনিয়ায়। বহদ্দারহাট টার্মিনালের বাস ধরলাম সেখান থেকে। বহদ্দারহাট যখন নামলাম প্রায় রাত নয়টা তখন। রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করতে হবে। বহদ্দারহাট মোড়ে প্রান্ত আর সুফিয়ান মিলে ‘কাশ্মীর’ নামক এক রেস্টুরেন্টের সন্ধান দিলো। যেহেতু এ ট্যুরের শেষ খাওয়া, তাই কাচ্চি খাওয়ার উদ্যোগ নেয়া হলো। খেতে খেতে আড্ডা হলো। ইচ্ছে ছিলো কাপ্তাই লেকে কায়াকিং করার, কিন্তু যথেষ্ট সময় ছিলো না হাতে। তা নিয়ে কিছুক্ষণ আফসোসও চললো। তবে যতোটা শক্ত সময় ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে গিয়েছে পুরো ভ্রমণ পরিকল্পনা, সেক্ষেত্রে আমরা সফল বলাই যায়।

বহদ্দারহাট থেকে লেগুনা করে অলংকার মোড়। শেষ বাস ছিলো রাত ১২ টায়; উঠে পড়লাম বাঁধনে। এ বাসই পৌঁছে দিবে আমাদের নোয়াখালী। টানা দু’ রাত ভালো ঘুম হয়নি, শরীরের উপর ধকল গিয়েছে প্রচুর। পুরো রাস্তাটাই ঘুমিয়ে পার করলাম। ভোর সাড়ে চারটায় নোয়াখালী এসে পৌঁছুলাম। নতুন দিনের সূর্য বরণ করে নিলো একঘেয়ে শহুরে জীবনে।

 

বিলাইছড়ি: রাঙামাটিতে ঝর্ণার ভূ-স্বর্গ (প্রথম পর্ব)

বিলাইছড়িঃ মুপ্পোছড়া, ন-কাটা ও গাছকাটা ঝর্ণার দেশে (দ্বিতীয় পর্ব)

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.