কোনো ট্যুরে গেলে আমার মূলত একদম ঘুমাতে ইচ্ছে করে না, মনে হয় এই বুঝি কোনো আনন্দদায়ক ব্যাপার চোখের অগোচরে চলে গেলো; কিংবা এমন কোনো ঘটনা ঘটে গেলো, যা আমার জীবনে অভূতপূর্ব। ছোটবেলায় স্কুল পালানোর চিন্তায় যেমন বুক ঢিপঢিপ করতো, ঘুম আসতো না সারা রাত। অনেকটা তেমন করে এসমস্ত ট্যুরের রাতে আমার ঘুম আসতে চায় না বিপুল উত্তেজনায়, অথবা ঘুমালেও নির্ধারিত সময়ের আগেই জেগে ওঠার এক বদঅভ্যাস গড়ে ফেলেছি। রাত আড়াইটা থেকে সোয়া পাঁচটা: এটুকু সময়ই ছিলো বিলাইছড়ি ট্যুরে আমার প্রথম রাতের ঘুমবিরতি। এ ট্যুর ইভেন্টের অন্যতম সংগঠক হিসেবে, আমি আর তাসমিয়াহ মিলে সকলকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেয়ার মতো দুরূহ কাজটি শেষ করলাম। তারপর নিজ রুমে ফিরে কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়ালাম, হোটেলের বারান্দা থেকে দূরে সূর্যের আভাস টের পাওয়া যায় নি তখনো। ভালো করে তাকালে কুয়াশায় মোড়া আবছা কাপ্তাই লেকের পানি চোখে আছড়ে পড়ে। রাঙামাটি শহরটা এখনো জেগে উঠেনি, অথচ আমরা কিছু ভ্রমণপাগল মানুষ জেগে উঠেছি শহর ছেড়ে বুনো গভীরতায় নিজেকে সঁপে দেয়ার জন্য।

ছয়টা বাজার কিছু আগেই সব ব্যাগ গুছিয়ে নেমে পড়লাম হোটেলরুমকে বিদায় জানিয়ে। আগেরদিনের ‘ভাতের হোটেলে’ সকালের নাস্তার কথা বলে রেখেছিলাম। নির্ধারিত সময়ের মাঝেই দেখলাম গরম গরম খাবার প্যাকেটভর্তি করে সাজানো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু-একটা ছবি তুলে পা বাড়ালাম ঘাটের দিকে। গতকাল রাতে দেখা নৌকাটা একই জায়গায় বাঁধা রয়েছে, বিশাল নৌকায় খুব সহজেই ১৭ জনের জায়গা হয়ে যাবে। একে একে উঠে পড়লাম নিজ ব্যাগ, পর্যাপ্ত খাবার পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে। দোদুল্যমান নৌকাটায় পা বাড়াতেই, দোলুনীর পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছিলো কয়েকগুণে। কেউ কেউ বেশ ভয় পাচ্ছিলো নৌকায় উঠতে, যেন ‘এই পড়ে গেলাম রে’ অবস্থা। বিশাল নৌকার নিচে বসার জায়গা আছে অনেক; আবার উপরের পাটাতনেও সহজেই বসা যায়, উঠার জন্য রয়েছে কাঠের সিঁড়ি।

রশির কাছাটা খুলে গুটিয়েই মনসুর (মাঝি) ভাই ইঞ্জিনটা চালিয়ে দিলেন, মুহূর্তেই বিরক্তিকর ভটভট আওয়াজে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। নিচে শব্দ বেশি কানে লাগে বলেই সবাই উপরে ‘দে ছুট।’ সবাই যখন একটু দম নিয়ে বসলো, মনোযোগ চলে গেলো চারপাশে। নৌকা একটু-একটু করে ছাড়ছে ঘাঁট, লেকের সীমানা বাড়িয়ে চলছে আরও দূরে। সূর্য তখনো তার প্রখর বাহু মেলে ধরেনি। যতদূর চোখ যায়, সবুজ পাহাড়ের ফাঁকে মেঘগুলো আঁটকে রয়েছে। মনে হচ্ছিলো যেন পাহাড় বুঝি খেলাচ্ছলে কাঁধে চড়িয়েছে মেঘকে, যেমন করে শিশুকে তার বাবা তোলে কাঁধে! সাড়া শব্দহীন নিস্তব্ধতায় যেন হারিয়ে গেলো সবাই কিছুক্ষণের জন্যে। ভোর শেষে সকালের চঞ্চলতায় ভাগ বসাতে যাবে প্রকৃতি, আর আমরা সেই চঞ্চলতার ভাগ না নিয়ে কেমন মোহাবিষ্টের মতো সমস্ত ইন্দ্রিয় নিয়ে প্রকৃতিসুধা পান করছি। জলের হাওয়ায় সঙ্গীত রচনা হলো মনের সাথে শরীরের; কিছুক্ষণ পরেই উৎফুল্ল হয়ে সবাই চিৎকার করতে শুরু করলো, যেন মনের শিশুটি জেগে উঠলো সবার। সামি আর নিশান দুই ফটোগ্রাফার ব্যস্ত হয়ে পড়লো ছবি তোলায়, আমরা গল্পে মশগুল হলাম।

আড়াই-তিন ঘন্টা প্রান্তের টুংটাং উকুলেলে বাজিয়ে গান, আর মুখরিত গালগপ্পেই কেটে গেলো। একফাঁকে সকালের নাস্তা সেরে ফেললাম নৌকাতেই, শুকনো খিচুড়ি-ডিম দিয়ে। ‘গাছকাটা আর্মি ক্যাম্পে’ যখন পা রাখলাম তখন ঘড়িতে প্রায় নয়টা। বিলাইছড়িতে আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ব্যাপারটা বলতেই একদম ভুলে গেছি। এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব জোরদার, তাই আসার সময় ব্যাগে করে নিয়ে আসতে হবে অন্তত তিন কপি জন্মসনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি। গাছকাটা আর্মি ক্যাম্পে যাত্রীসংখ্যা ও যাত্রা উদ্দেশ্য জিজ্ঞাসাবাদের পর সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে সকলের ছবি তুলে নেয়া হলো। মজার ব্যাপার হলো আর্মি ক্যাম্পে ছবি তোলা নিষিদ্ধ হলেও, ১৭ জনের দারুণ সংঘবদ্ধ একটি ছবি পেয়ে গেলাম। এছাড়াও জানিয়ে দেয়া হলো, সন্ধ্যা ছয়টার আগেই ফিরে যেতে হবে বোর্ডিং এ। তারপর নৌকায় উঠে আবার যাত্রা। এক্ষেত্রে একটু বলে রাখি, আর্মি ক্যাম্পে থাকা অবস্থায়ই আমাদের বুকিংকৃত বিলাইছড়ির বোর্ডিংয়ের কর্তৃপক্ষের সাথে মুঠোফোনে কথা বলে দুপুরের খাওয়ার অর্ডার করে ফেলি।

একসময় দুইপাশের কাপ্তাই লেকের জলরাশি সীমিত হয়ে সরু হয়ে গেলো, অর্থাৎ নৌকা থেকে দুপাশের পাড়ের দূরত্ব কমে এলো অনেকখানি। একটা বড় নৌকাই কেবল স্বাচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে এমন অবস্থাতে গিয়েও ঠেকলো একটু পরেই, খানিকটা আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে যেতে লাগলো আমাদের নৌকা। মাঝি ভাইয়ের সাথে কথা বলে জানা গেলো, আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না আমাদের। দশটার মাঝেই পৌঁছে গেলাম ‘গাছকাটা ঝর্ণার’ ঝিরিপথে। ৫০০ টাকায় একজন গাইড দাদাকে যোগাড় করে দিলেন মনসুর ভাই; বললেন, “অবশ্যই একটার ভিতর চলি আইভেন, নইলি বাকি ঝর্ণা ইয়ুন দেখ্যাইতে ন পাইর্যুম।” নৌকায় সবকিছু রেখে কেবল প্রয়োজনীয় পানি, মোবাইল, প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম এক ব্যাগে ঢুকিয়ে নেমে পড়লাম ঝিরির উদ্দেশ্যে।

গাইডের পথ অনুসরণ করেই আমরা হাঁটা শুরু করলাম। আমার জীবনে খুব বেশি ঝর্ণায় পরিভ্রমণ না করা হলেও, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড পাহাড়গুলোর বেশ কিছু ঝর্ণায় যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এতো পিচ্ছিল ঝর্ণা যাত্রাপথ আমি আগে দেখিনি। আগের দিনের বৃষ্টিতে সমস্ত পথ কাদায় ভর্তি। প্রতি পদেই একবার করে পড়ে যাওয়ার ভয় বুকে হানা দিচ্ছিলো। সমস্যা হলো কাদাগুলো আঠালো ভীষণ, এক পা দেয়া মাত্রই জুতাসমেত চোরাবালির মতো নিচের দিকে খানিকটা টেনে নেয়। তারপর সেই পা অনেক কষ্টে উদ্ধার করতে-না-করতেই আরেক পা গ্রাস করে নেয় কাদা। কাদা এড়ানোর জন্য অবশ্য যখনই ঘাসের দেখা পাচ্ছিলাম, তা মাড়িয়ে যাচ্ছিলাম সবাই। কিছু কিছু জায়গায় তো রীতিমতো বসে যেতে হচ্ছিলো, গড়িয়ে-গড়িয়ে আমি পার হয়েছি বেশ কিছু পথ। একসময় জুতাজোড়া হাতে নিয়েই নিলাম, আর প্যান্ট খানিকটা গুটিয়ে একে-ওকে ধরে হাঁটতে লাগলাম। সত্যি বলতে পুরো ট্রেকিংয়ে এ যাত্রাটা অস্বস্তিকর ছিলো সবচেয়ে বেশি। বেশ কয়েকবার আছাড়ও খেলো কেউ কেউ।

ঘন্টাখানেক কর্দমাক্ত রাস্তায় হাঁটছি, তার মাঝে মাঝে দেখা পেলাম সরু রাস্তার দুপাশে উঁচু ঘাস। খানিকটা স্বস্তি এলো মনে। বিশাল সবুজ ক্ষেত ফেলে মাঠের মাঝের আইলও পেরিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। যেতে যেতে স্থানীয় আদিবাসীদের কাঁধে ঝুলি ভরে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্য আনা-নেয়া করতে দেখলাম; কি স্বাচ্ছন্দেই না তারা হাঁটছে! মাঝে একজনের ঝুঁড়িতে কমলা দেখে গোটাকয়েক কমলাও কিনে ফেললাম। তবে এতো টক কমলা আমার জীবনে কমই খেয়েছি!

তারও আধঘন্টা পর ঝিরিপথ দেখতে পেলাম, শান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ঐ পিচ্ছিল পথের চেয়ে ঝিরিপথে অন্তত দ্বি-গুন গতিতে হাঁটা যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে পায়ে নিচে পড়ছিলো নুড়ি পাথর, আবার বড় ও উঁচু পাথরের উপরেও পা ফেলতে হচ্ছিলো। জায়গায় জায়গায় পিছলিয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল, সন্তর্পণে সবাই পা ফেলে এগুচ্ছিলাম। আমাদের ছোটভাই রূপক পাথরে পিছলিয়ে পড়ে পায়ে ব্যাথাও পেয়েছিলো বেশ। একসময় একটা ঢালু বড় ক্যাসকেড দেখলাম; জলহীন প্রায়। ভাবলাম এটা বুঝি গাছকাটা ঝর্না! পরে জানলাম এটা না, ঝর্ণা আরও সামনে। ওদিকে গাইড দাদা প্রথম থেকে বলেই যাচ্ছেন, ‘আর বিশ মিনিট’ হাঁটলেই নাকি পাওয়া যাবে ঝর্না! এ ২০ মিনিট দুই ঘন্টায় গিয়ে ঠেকলো এবং অবশেষে দেখা মিললো বিশাল গাছকাটা ঝর্ণার।

ঝর্ণা দেখামাত্রই গাঢ় করে বুনো গন্ধে ভরিয়ে ফেললাম ফুসফুস। ভীষণ আনন্দ লাগছিলো সবার, ঝর্ণার অবারিত ধারায় শরীর ভিজিয়ে নেয়ার তৃষ্ণা পেল। আর এ ঝর্ণার পানিও ছিলো প্রচুর।

তবে এ ঝর্ণার ক্যাসকেড ভীষণ পিচ্ছিল। ছোট-ছোট পায়ে, সময় নিয়ে এগুতে হয় ঝর্ণার পানিতে শরীর ডুবানোর জন্য। এ ঝর্ণার আপস্ট্রিমে যাওয়ার চেষ্টা করলো না কেউ অবশ্য। একে তো হাতে সময় নেই, তার উপর দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাও তীব্র। ২০-২৫ মিনিট সময় ব্যয় করে, নিজের মতো করে ভিজে ফিরতি পথ ধরলাম। ফেরার পথটা কেমন যেন বেশ সহজেই শেষ হয়ে গেলো! সূর্যের তেজ রাস্তা শুষ্ক করে দেয়ায় আমাদের জন্যে ফিরতি পথ ভীষণ সহজসাধ্য আর স্বস্তিকর হলো। নৌকার কাছে আসলাম যখন, ঘড়িতে তখন দেড়টা । মনসুর ভাই মিষ্টি করে বকে দিলেন দেরির জন্য, তারপর টিপ্পনী কেটে জানালেন ইচ্ছে করেই একটু আগে আসতে বলেছেন। আমরা সময়মতোই আসতে পেরেছি। বেলা দু’টোর ভেতর বিলাইছড়ি বাজারে গিয়ে দুপুরের ভাত-মুরগীর প্যাকেটগুলো নিয়ে নিলাম।
বিলাই অর্থ বিড়াল আর ছড়ি অর্থ ঝর্ণা। শোনা যায়, ঘন অরণ্যে ঘেরা এলাকাটিতে কিছু পাহাড়ী লোক কাঠ কাটার জন্য জড় হয় এবং এক বিশাল বনবিড়াল দ্বারা আক্রান্ত হয়। অতিমাত্রায় হিংস্র বনবিড়াল দেখে তারা ভড়কে যায়, কিন্তু সাহস না হারিয়ে তাকে তাড়াবার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে বেশ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর বিড়ালটিকে মেরে ফেলতে সক্ষম হয়। মৃত বিড়ালটিকে পাড়ায় নিয়ে আসলে, স্থানীয়রা বেশ আশ্চর্য হয় এবং ঘটা করে বিরাট সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

সে যাই হোক, মূল কথায় ফিরি। দুপুর দুইটার মধ্যে খাবার সংগ্রহ করে আমরা পাড়ি দিলাম বাঙ্গালকাটার উদ্দেশ্যে। প্রায় ৩০-৩৫ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম, এর মাঝে পেট ভরিয়ে ফেললাম দুপুরের খাবার খেয়ে। ভরপেটে ট্রেকিং করা অবশ্যই দূরুহ কাজ, কিন্তু উপায় নেই। এখানেও ৫০০ টাকায় একজন গাইড দাদাকে ঠিক করে চললাম দাদার পিছু পিছু। বিকেল ঘনিয়ে আসছে, যে সময়টা ভাতঘুমের; অথচ আমরা ছুটছি আরও দুটো ঝর্ণা জয়ে! দু’ ঘন্টার মাঝেই দুটো ঝর্না দেখে ফিরতে হবে আমাদের কারণ ছয়টার পর আর্মি ক্যাম্প থেকে আমাদের আর বোর্ডিংয়ে ফিরতে দেবে না। হ্যাঁ, এখানকার নিরাপত্তা নিয়মটি এমনই। এমন একটা চাপ মাথায় নিয়েই এগিয়ে চলছি আমরা সকাল থেকে। প্রথমে কাদা শুকিয়ে যাওয়া রাস্তা ভেদ করে হাঁটলাম কিছুক্ষণ। পাহাড়ী পল্লী পেরিয়ে ঝিরিপথের দেখা মিলতে অবশ্য বেশি সময় লাগলো না। কথা বলতে-বলতে এগুচ্ছিলাম, এতে করে শরীরের ক্লান্তিটা টের পাওয়া যাচ্ছিলো না তেমন। কখনো বিশাল পাথরের উপর দিয়ে, কখনো বা জলস্রোতের উপর পা টিপে-টিপে হাঁটছি। খেয়াল করলাম, সজলের বন্ধু ফাহিম গতকালও বেশ অপরিচিত ছিল আমাদের বাকি ১৫ জনের কাছে। কিন্তু আজ কথা বলতে গিয়ে মনে হলো যেন বহুদিন ধরে তাকে চিনি। মুন্না ভিন্নমাত্রার মজার-মজার কথা শুনাচ্ছিলো, কখনো সুফিয়ান-রূপকের সাথে গিয়েও টুকটাক গল্প করছিলাম।

কিছু জায়গায় ছবি তোলার জন্য থামা হচ্ছিলো, অবাক হয়ে দেখলাম ফটোগ্রাফার মানুষগুলোর ট্রেকিংয়ের কষ্ট অন্যান্যদের চেয়ে অনেক বেশি । লেন্স-গ্যাজেট সমেত বিশাল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে, গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে নিশানকে দেখে বুঝলাম কি অদ্ভুত শারীরিক পরিশ্রম চলছে বেচারার। সামি আর মামুনকে দেখলাম সেলফিস্টিকসমেত মোবাইল হাত বদল করে এগুচ্ছে। যেখানে আমি আমার চার হাত পা সমানভাবে কাজে লাগিয়ে আগাতে থাকি, প্রয়োজনে মাটি আঁচড়ে চলি; সেখানে অতিরিক্ত ভার বহনের পাশাপাশি এক হাতে এমন ভারী কিছু একটা নিয়ে খুব সাবধানতার সহিত ট্রেকিং করার ব্যাপারটাকে বেশ শ্রদ্ধার চোখেই দেখলাম আমি। প্রান্ত আর মেজবাহ ট্রেকিংয়ে খানিকটা দূর্বলদের নিয়ে হাঁটছিলো সবার পিছনে।

বিকেলের শেষ সূর্যের আলো যার মুখেই পড়ছিলো, অনিন্দ্যসুন্দর লাগছিলো তাকে। জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট ঝর্ণা আর ক্যাসকেড পেড়িয়ে যাচ্ছিলাম, তবে ঝিরিপথ খুব একটা পিচ্ছিল লাগছিলো না কিছু জায়গা ছাড়া। কিছুদূর গিয়ে থেমে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম দাঁড়িয়ে বা বসে। যতোই এগোচ্ছিলাম, বুনো থেকে আরও বুনো পরিবেশের দেখা পাচ্ছিলাম। প্রতি নিঃশ্বাসে জল-মাটি-পাহাড়ের একাত্মতায় মাখা ঘ্রাণ। একেক সবুজের ঘ্রাণ আসলে একেক রকম। সারিবদ্ধ গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ বাগানের সবুজে যে ঘ্রাণ, কিংবা পাহাড়ী রাস্তায় গাছ আর জংলার সবুজে যে ঘ্রাণ পাওয়া যায়; অন্যদিকে ঝিরিপথের আদিম সবুজ ঘ্রাণ যে কতোটা পৃথক, তা কেবল নীরব নিভৃতে সবুজে শ্বাস নিয়েই বোঝা সম্ভব।

ন-কাটা ঝর্নায় এসে পৌঁছালাম পাক্কা ১ ঘন্টা ট্রেকিংয়ের পর। আগের ট্রেইলের চেয়ে এই ট্রেইলে কষ্ট কম হয়েছে কারণ পুরোটাই ঝিরিপথ। ন-কাটায় যখন পৌঁছেছি, আরও বেশ কিছু পর্যটক ছিলেন। উনারা ভিজছিলেন দেখে আমাদের ঝর্ণায় ভিজতে বেগ পেতে হচ্ছিলো। বেশ পানি ছিলো ঝর্ণায়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সুযোগ বুঝে আমরাও ঝর্ণার খাঁজে বসে ভিজতে লাগলাম। হাতে সময় বেশি নেই; প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। এর মাঝে নেশাগ্রস্তের মতো ঝর্ণার আপস্ট্রিমে উঠতে লাগলো প্রান্ত, মেজবাহ, সজল, ফাহিম, মুন্না আর রাহাত।

গাইড দাদা জানালেন, ন-কাটা থেকে মুপ্পোছড়ার দূরত্ব ১০-১৫ মিনিট। মনে মনে হিসেব কষে নিলাম উনার দশ মিনিট মানে আমাদের কমপক্ষে আধাঘন্টা তো হবেই! ন-কাটার আপস্ট্রিম দিয়েই মূলত মুপ্পোছড়ায় যাওয়ার রাস্তা, একটা সরু উঁচু পথ দেখিয়ে গাইড নিয়ে চললো হাতের ডান পাশ দিয়ে। রাস্তায় কাদামাটি আর পাথরের সন্নিবেশ। লক্ষ্য করে দেখলাম, বিকেলের গাঢ় আলোটা উধাও হয়ে যাচ্ছে, চারিপাশে ঘন বনের কারণে সমস্ত আলো ঢাকা পড়তে শুরু করেছে!

নিস্তব্ধ পরিবেশটাতে নিজের হৃৎপিন্ডের লাব-ডাবও শোনা যাচ্ছে; দিনের আলোতেই নামছে ভূতুড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। একবার মনে হলো সম্ভবত মেঘ করেছে, বৃষ্টি হবে। আকাশের দিকে তাকাতে দেখলাম আকাশ কই? বড় বড় গাছের কারণে ঢাকা পড়েছে আকাশ। একপাশে পাহাড়ের ঢালু অংশ নেমে গেছে, আরেকপাশে ঘন জঙ্গল; মাঝে সরু পথ। একজন-একজন করে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই এখানে। এলোমেলো পা দিলেই তাল হারিয়ে পাহাড়ের খাঁজে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কেউ কাউকে ধরে যে হাঁটবে সে উপায়ও নেই। তার উপর পিচ্ছিল শ্যাওলা ধরা পাথুরে পথে নিজের ভারসাম্য রেখে সামনে এগিয়ে যেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিলো।

আমাদের হিসেব খুব একটা ভুল ছিলো না, প্রায় ৪৫ মিনিটের মাথায় দেখা পেলাম মুপ্পোছড়ার। কিন্তু, এ কী! বিশাল ঝর্ণা, প্রায় জলহীন। এতোটা ভয়ানক পথ পাড়ি দেয়ার মূল্যে ঝর্ণার এই মৃতদশা দেখে সবার বেশ মন খারাপই হয়ে গেলো। বোঝা যাচ্ছিলো ভরা বর্ষায় বিশাল এই ঝর্ণায় মনের আঁশ মিটিয়ে ভেজা সম্ভব। কিন্তু এখন যেই অবস্থা ঝর্ণার, তাতে আরও দশ মিনিট ট্রেকিং করে ঝর্ণায় যেয়ে ভেজার চেষ্টা করাটা বোকামো হবে। বেশ দূর থেকেই ঝর্ণাটা দেখা যাচ্ছিলো বলে আর কাছে গেলাম না। কিছু ছবি তুলে নেয়া হলো দূর থেকে। রাহাত ছেলেটা জ্বালাতন শুরু করলো ঝর্ণার আপস্ট্রিমে যাবে বলে। হাতে সময় বেশি নেই; ৪ টা পেরিয়ে গেছে, এখনই রওনা না দিতে পারলে ৫ টার ভিতর নৌকায় ফেরা সম্ভব না। উপায়ান্তর না দেখে তার মনে কষ্ট নিয়েই ফেরার পথ ধরতে হলো। মুপ্পোছড়া থেকে আবার ন-কাটার পথ হয়েই ফিরতে হবে, অন্ধকার আরোও ঘন হচ্ছে। চোখে প্রায় কিছুই ঠাহর করা যায় না। দু’-তিনজন পিছলে পড়লো কয়বার। ন-কাটায় ফেরৎ আসার পর দেখলাম, আলো বেড়েছে কিছুটা! বুঝলাম, কী পরিমাণ গহীনতায় প্রবেশ করেছিলাম সদলবলে।

মুপ্পোছড়া থেকে শেষ বিকেলের আলো মাখিয়ে ফেরার পথটা অসাধারণ ছিলো। একে তো কষ্ট কম হচ্ছিলো, তার উপর তিনটা ঝর্ণা একই দিনে সফলভাবে দেখার আনন্দে বিহ্বল আমরা। শুনেছি অনেকেই দ্বিতীয় দিনে এ ৩ টি ঝর্ণায় পদচারণা শেষ না করেই কটেজে ফিরে গিয়েছে কেবলমাত্র সঠিক সময় ব্যবস্থাপনার অভাবে।

সন্ধ্যা নেমে গেছে। নৌকা যেখানে বাঁধা ছিলো, তার পাশেই একটা চায়ের দোকান। ভেজা শরীর শুকোতে-শুকোতে এসেছি। কাদায়-বালুতে মাখামাখি পুরো শরীর, ক্লান্তিতে অবসন্ন। কিন্তু, মন? আনন্দে পরিপূর্ণ ও ক্লান্তিহীন। চায়ের কথা বললাম দোকানে, প্রান্ত বুট-চানাচুরের প্যাকেট ছিঁড়তে লাগলো দোকান থেকে নিয়ে। মনসুর ভাই এসে বাঁধা দিয়ে জানালো তাড়াতাড়ি রওনা দিতে হবে। চা খেয়ে- না খেয়ে চায়ের বিল পরিশোধ করে উঠে পড়লাম দ্রুত। নৌকায় যখন উঠলাম ছয়টা বাজতে আর কুড়ি মিনিট বাকি। সবাই অবসন্ন শরীর নিয়ে নৌকায় শুয়ে বা বসে পড়লো।
বিলাইছড়ি বাজারে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পার হয়ে গেলো। ঘাটে নৌকা বাঁধা হলো, আমরা একে একে ব্যাগ নিয়ে নেমে পড়লাম। আমরা যে বোর্ডিংয়ে বুকিং দিয়েছিলাম, তার নাম ‘স্মৃতিময় বোর্ডিং’। ঘাট থেকেও দু-তিন মিনিট ইটের রাস্তায় হাঁটতে হলো। অপ্রশস্ত রাস্তার দুপাশে দেখা গেলো বেশ কিছু ভাতের হোটেল। বোর্ডিংয়ে পৌঁছে রীতিমতো ধাক্কা খেলাম। কোথায় বোর্ডিং? নেই কোনো রুম! পুরো খোলা ছাদ, মাঝে দু -একটা পিলার উঠে আছে। হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো আরেকটু সামনে, দেখলাম সিঁড়ি ঘর একটা। নিচে নামতে লাগলো উনি, আমরাও অনুসরণ করলাম। অবাক হয়ে বুঝলাম বোর্ডিংটা পুরো ভূগর্বস্থ। বেশ মজাই লাগছিলো। মূলত ঘাট থেকে বেশ উপরে উঠতে হয়েছিলো আমাদের আসার পথে, তো দালানের উপরে ছাদ থেকে নিচে নামতে হয়। দেখলে মনেই হবে না, নিচে যাওয়ার সিঁড়িও আছে। নিচে দুটি তলা আছে। উপরে দুটি, আর নিচে দুটি ডাবল বেডের রুম বুক করা ছিল। যার যার রুম বুঝিয়ে দেয়া মাত্র ঢুকে পড়লাম। ১০০০ টাকা করে প্রতিরুম। দাম একটু বেশিই লাগছিলো। কিন্তু রুমের ভিতর ঢুকে আরেকটা ছোটমতো ধাক্কা খেলাম। ‘একটি রুম’ বলতে আসলে আমরা যা বুঝি- এক খাটে সর্বোচ্চ দু’ জন ঘুমুতে পারবে এমন দুটি খাট, আর অল্প একটু জায়গা নিয়ে একটি রুম। কিন্তু এখানে ‘একটি রুম’ বলতে আসলে দুটো রুমের সমন্বয়। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়েই বলি; একটা ছোটখাটো বাসার মতো, যে বাসায় পাশাপাশি দুই রুম এবং বাথরুমও আছে। প্রতিটি রুমেই রয়েছে বিশাল খাট, মানে চাইলে একখাটেই চারজন ঘুমুতে পারবে। সেক্ষেত্রে যেই ‘রুমে’ আমরা চারজন ছিলাম, সেখানে চাইলে আটজনও থাকতে পারতো নির্দ্বিধায়। রুমের জানালা দিয়ে তাকালে লেকের একাংশ দেখা যায়।

গোসল সেরে ফেললাম যার যার মতো, কিন্তু বিপত্তি ঘটলো মাঝে মোটর বন্ধ করে দেয়ায়। পরে অবশ্য সে সমস্যাও সমাধান হলো। সবাই নিজ নিজ কক্ষে খানিক বিশ্রাম নিচ্ছিলো। এর মাঝে সবার নাম এন্ট্রি করাতে হলো । মনসুর ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছিলো রাতে কাপ্তাই লেকে নৌকায় খানিক ঘুরাবে আমাদের। আমি, প্রান্ত সেন, মেজবাহ, সুফিয়ান বসে খরচের হিসেব করে ফেললাম সারাদিনের। তারপর আস্তে ধীরে সবাই বোর্ডিং ছেড়ে বেরুলাম জায়গাটা ঘুরে দেখতে। বিলাইছড়ি আসার আগে শুনেছিলাম রাত দশটার পর এখানে আওয়াজও করতে মানা আছে। ঘাটের কাছাকাছি একটা দোকান ছিলো, এখানেই মূলত রাতের খাবারের অর্ডার করা ছিলো। ওখানে বসে চা পানসহ হালকা নাশতা করলাম। রাত তখন আটটারও বেশি। কেউ কেউ দোকানের ভিতর, কেউবা বাইরে বাতাস খেতে খেতে খোশগল্প করছে। সারাদিন শরীর আর মনের উপর দিয়ে ভালো-খারাপ যা গেছে, তারই বিভিন্ন ধাপ উপমা দিয়ে বলাবলি করছে সবাই।
সাড়ে আটটা নাগাদ মনসুর ভাইকে বলে নৌকায় উঠে পড়লাম। উনি জানালেন বেশি দূর যেতে পারবে না, নিষিদ্ধ এ ব্যাপারটা। বললাম, ‘তাই সই।’ চকচকে চাঁদ মেঘে ডুবে যাচ্ছে বারবার, নৌকা দূরত্ব ঘাট থেকে খুব বেশি হলো না; এই দু-এক মিনিট ইঞ্জিন চালু রাখলে যতোদূর যায়। নৌকার পাটাতনে সকলে গোল হয়ে বসলো। শুরু হলো এক মজার খেলা; একেকজনকে এ ট্যুরে উপস্থিত প্রতি ব্যক্তি সম্পর্কেই ভালো-খারাপ কিছু বলতে হবে। সত্যি বলতে চাঁদের আলোয় আবছা করে সকলের হাস্যোজ্জ্বল উৎফুল্ল মুখ দেখে দারুণ লাগছিলো, গল্প জমছিলো বেশ।
নয়টা কি সোয়া নয়টা করে খাবার দোকানে ফিরে চললাম। ভাত, মুরগী আর আলু ভর্তা দিয়ে খাওয়া পর্ব শেষ হলো। আরও কিছুক্ষণ বাইরে সময় কাটিয়ে বোর্ডিংয়ে ফিরলাম। আগের দিনের রাতের মতো সবাইকে একরুমে বসিয়ে পরদিনের কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা জানিয়ে দেয়া হলো। তারপর কিছু মানুষ চলে গেলো ঘুমোতে, আমরা গানের আসরে বসলাম। প্রান্তের উকুলেলের তারে আঙ্গুল পড়ছে, আর সূরের মূর্ছনায় ভাসছি আমরা। একসময় গলার আওয়াজ হাই-নোটে চলে গেলো, ভুলে গেলাম এখানে রাত দশটার পর খুব একটা আওয়াজ করার রীতি নেই! জোরে কথা বলতে গিয়ে মনে হচ্ছিলো এই বুঝি কেউ এসে নালিশ করবে; কিন্তু তেমন কিছুই ঘটলো না। সজল বাদ্যযন্ত্রহীন গলায় গেয়ে শুনালো অঞ্জন দত্তের বিখ্যাত গান ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা।’ নিশ্চুপ হয়ে আমরা গানটা শুনছিলাম, কেউ যেন নিঃশ্বাসও নিতে ভুলে গেছে! যেন একটু শব্দ হলেই গানটার অবমাননা হবে, ঘুরে আসলাম মায়াময় পাহাড়ের কোল থেকে কল্পনায়। সেই কাঞ্চনজঙ্ঘায় ফিরে যাওয়ার আকুতি আর ছেড়ে আসার হাহাকার আমাদেরও গ্রাস করলো। সজল যখন থামলো তখন বুঝলাম কী স্বর্গীয় সময় পার করছিলাম আমরা! হয়তো ক্লান্ত দেহ আর ভবঘুরে মনের জন্যেই এই পাহাড়ী জায়গায় ঐ গানটাই খুব সত্য হয়ে ধরা দিয়েছিলো। তা না হলে এর আগেও শোনা এ গানটা এতো ভালো লাগবে কেন? বন্ধুর গলার প্রশংসা আর আলাদা করে নাইবা করলাম।
একসময় পুরো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ঘুমোতে এলাম। আগামীকাল যাবো বিলাইছড়ির সবচেয়ে সুন্দর ঝর্ণা, ধুপপানিতে।