ফজরের আজান দিলো। আড়মোড়া ভাঙ্গতেই এলার্মও জানিয়ে দিলো ওঠার সময় হয়ে গিয়েছে। এলার্ম বন্ধ করে কাঁথাটা পায়ের সাথে জড়িয়ে আরো খানিকটা শুয়েই রইলাম। হঠাৎ মনে পড়লো কনককে তো ফোন দিয়ে জাগিয়ে দিতে হবে! ও সিএনজি নিয়ে আসবে মাইজদী বাজার থেকে; মেইন রোড থেকে উঠে পড়তে হবে আমাদের। চুল্লার চা দোকান, বিশ্বনাথ, হোয়াইট হল, দত্তেরহাট হয়ে সিএনজি ছুটে চলছে। রাস্তা ফাঁকা, খানিকটা কুয়াশায় মোড়া। ফোনে সবাইকে আগেই বলে রাখা হয়েছে মেইন রোডে এসে দাঁড়াতে; সোনাপুর অভিমুখে যেতে যেতে তুলে নেয়া হবে সবাইকে।
আজ আমাদের গন্তব্য নিঝুম দ্বীপ।
নিঝুম দ্বীপকে ‘ইছামতির চর’ এবং ‘বাল্লারচর’ বলেও ডাকা হতো। এ দ্বীপে সর্বপ্রথম বসবাস শুরু করেন ‘ওসমান’ নামের একজন বাথানিয়া এবং তখন থেকেই এর নাম ছিলো ‘চর-ওসমান’। ধারণা করা হয় ১৯৫৭ সালের দিকে বেশকিছু সংখ্যক বাথানিয়া এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করে, তবে ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকারী ‘ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের’ পর থেকে এখানে বসবাস অধিকহারে বেড়ে যেতে থাকে। ৪ জোড়া চিত্রা হরিণ বনবিভাগ ১৯৭৮ সালে এ দ্বীপের জঙ্গলে ছাড়ে এবং ১৯৯৬ সালের হরিণশুমারি অনুযায়ী হরিণের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২২ হাজারে। প্রশাসনিকসূত্রে ১৯৭৯ সালে এ দ্বীপের নাম ‘নিঝুম দ্বীপ’ রাখা হয় এবং প্রায় ২ কোটি ৪৩ লক্ষ বৃক্ষরোপন করা হয়। শীতের শুরুতে অগণিত অতিথি পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয় এ দ্বীপ এবং সারা বছর প্রায় ৩৫ রকমের পাখ-পাখালির মেলা চোখে পরে। এ দ্বীপ ‘চেঁউয়া’ মাছের শুটকি প্রস্তুতে জনপ্রিয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ৮ ই’ এপ্রিল, ২০০১ সালে নিঝুম দ্বীপকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়
নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে যাত্রা শুরুর প্রথম ধাপেই দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে, লঞ্চে ভ্রমণ ব্যতীত, চলে আসতে হবে সোনাপুর বাসস্ট্যান্ডে। সোনাপুরেই পাশেই নোয়াখালী রেলস্টেশন এবং আন্তঃজেলা বাসগুলোর এটাই শেষ গন্তব্য। আমাদের নিঝুম দ্বীপ গন্তব্যের সদস্য সংখ্যা এখন ১৩ জন; রাকিব, সুপ্তি, কনক, তাসমিয়াহ, সাকিব, হৈমী, ঋতু, রনি, সুফিয়ান, তুবা, তিথি আপু, সাকিব ভাই ও আমি রিফাত, তাই আমাদের ঠিক করতে হলো ৩ টা সিএনজি। দরদাম করে মাথা প্রতি ৯০ টাকা হিসেবে রওনা হলাম তিন চাকার এ যানের পর্দা টেনে যেন ঠান্ডা বাতাসে জমে না যাই!
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, চারপাশ তখনো আবছা কুয়াশায় মোড়া। ভোরের আলো ফোটে নি; চাঁদ ডুবে গিয়েছে ততক্ষণে। ভোরের কুয়াশা ভেজা ঠান্ডা সতেজ বাতাস আর সদ্য জেগে ওঠা গাছে-গাছে পাখির কিচির-মিচির শুনতে শুনতে ফাঁকা পিচের রাস্তা ধরে ছুটে চলছি আমরা একই গতিতে; এবারের উদ্দেশ্য চেয়ারম্যানঘাট। সেখানে পৌঁছে সি-ট্রাকে করে হাতিয়ার নলচিড়া ঘাট। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বাজার, ভাটিরটেক পার করে আমরা চলছি চেয়ারম্যানঘাটের উদ্দেশ্যে। সমিতির দোকান থেকে তুলে নিলাম মুন্নাকেও। আমাদের নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের মোট সদস্য এবার ১৪ জন পূর্ণ হলো।
চেয়ারম্যানঘাট যখন পৌঁছুলাম চারপাশে ততক্ষণে আলো ফুটে গিয়েছে তবে কুয়াশায় গুমোট হয়ে ছিলো গাছগুলোর মগডাল। সিএনজি থেকে নেমে জানলাম, এ ঘাটে ভাটা; আমাদের যেতে হবে চতলারঘাটে, সেখানেই সি-ট্রাক নোঙর করে আছে। চেয়ারম্যানঘাট থেকে চতলার ঘাটের দূরত্ব হেঁটে ১৫ মিনিট আর সিএনজিতে ৫ মিনিট। আমাদের কাছে ব্যাগ থাকায় চালকমামা পৌঁছে দিলেন চতলার ঘাটে, ভাড়া রাখলেন ১০ টাকা বেশি; মোট ১০০ টাকা।
চতলারঘাট জায়গাটা দারুণ। একপাশ দিয়ে গ্রামে ঢোকার মেঠো পথ, পথের দু’ ধারে সারি সারি সবজি লাগানো মাঁচায়। মেঘনা নদীর পানি আছড়ে পড়ছে নদীর পাশের বাড়িগুলোর উঠোনে। দূষণহীন টাটকা বাতাস। সকালের বাজারে ব্যস্ততা বেশি। সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করেই আমাদের প্রথম পরিকল্পনা সকালের নাস্তা সেরে ফেলবো এখানেই। গ্রামের নাস্তার টং-হোটেলগুলোর দিকে হেঁটে সামনে এগোতেই চোখে পড়লো এক রাস্তার পাশেই বেশ জটলা; খোঁজ নিয়ে জানলাম এটা ট্রলারের টিকেট কাউন্টার। নলচিরা ঘাটে ইচ্ছে হলে ট্রলারে করেও যাওয়া যায় চতলারঘাট কিংবা চেয়ারম্যানঘাট থেকে; নির্ভর করে জোয়ার-ভাটার সময়ের উপর। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সি-ট্রাকেই যাবো কারণ ‘নিরাপত্তাই প্রথম।’ নাস্তা সেরে ফেললাম সবাই। অল্প ক’জন ভাত খেয়ে ফেললো, বাকিরা ডিম-পরোটা; ক’ জনে চা-পরোটা খেয়েই অপেক্ষার প্রহর গুণছে কখন সি-ট্রাক ছাড়বে। রাস্তা থেকে সি-ট্রাক পর্যন্ত পথে ইটের সলিং ফেলানো; আমাদের বালির বস্তার উপর হেঁটে সি-ট্রাকে উঠতে হবে। বস্তাগুলো ছিলো যথেষ্ট পিচ্ছিল; শ্যাওলা পড়ে সবুজ হয়ে গিয়েছে জায়গায়-জায়গায়।
‘পিছলা খাইলাম রে’- বলতে-না-বলতেই সবাই উঠে পরলো সুস্থদেহে সি-ট্রাকে, কেবল সাকিব ছাড়া । বেশ ভীড়; আমরা চেষ্টা করলাম সি-ট্রাকের উপরের তলায় যাবার। ভীড় ঠেলে এপাশ-ওপাশ করে জাহাজের পেছনের খোলা অংশে চলে গেলাম, এখান থেকে আকাশ দেখা যায় পুরোটা। একটা বেঞ্চ পাওয়া গেলো- বসতে পারে ৩ জন। আমাদের ৩ জনকে বসতে বলে বাকিরা সবাই রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে শুরু করলো আড্ডা, গল্প, গান। সি-ট্রাক ছাড়লো। টিকেট পরিদর্শক এসে টিকেট চাইতেই স্বভাবসুলভ টিকেট দেখানো হলো সবার। এখানে ঘটলো মজার এক ঘটনা; টিকেট পরিদর্শক বললেন- ‘বেঞ্চের ৩ মহিলার ভাড়া দেবেন ক্যাডা?’ আমরা খানিকটা অবাকই হলাম! হ্যা, এই সি-ট্রাকগুলোর নিয়ম যে-কেউ এই কাঠের বেঞ্চগুলোতে বসে গেলে তাকে গুনতে হবে অতিরিক্ত ১০ টাকা করে ভাড়া!
এগিয়ে চলছে আমাদের নৌ-যান, গল্পের ফাঁকে ফাঁকে সবাই হো-হো করে হেসে উঠছে বারংবার। তবে জাহাজের ইঞ্জিনের শব্দে সে শব্দ মিলিয়েই যাচ্ছিলো বাতাসে। এক সময় কয়জন উঠে পড়লো সি-ট্রাকের ছাদে। এখান থেকে পুরো পৃথিবী অন্য রকম। চারপাশে যতদূর চোখ যায় অ-থৈ ঘোলা জল। অতল পানি কেটে আমাদের যান চলছে হাতিয়ার উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে গাঙের পানি যেন সুনিপুণ ধৈর্যে চারপাশ থেকে ক্রমশ স্রোত টেনে মুছে ফেলছে আমাদের স্রোতকেটে সামনে এগিয়ে যাবার গল্প।
আমরা নলচিরা ঘাটে পৌঁছুলাম দুপুর ১২ টায়৷ স্বভাবতই এই ঘাটগুলোতে পা রাখার সাথে-সাথেই ঘিরে ধরেন মোটরযান, নসিমন, চান্দের গাড়ি এবং লোকালবাসের চালকবৃন্দ। জাহাজমারা হয়ে ‘মোক্তারিয়া ঘাটে’ খুব আরামে পৌঁছে দেবে বলে আশ্বাস দিচ্ছিলেন সব চালক ভায়েরা। বলে রাখা ভালো, পাহাড় ব্যতীত সমতলে দেশের কেবল এখানেই প্রথম দেখি ‘চান্দের গাড়ি’। আমরা লঞ্চ থেকে নেমে একটা দোকানে বসলাম স্থির হয়ে। সাকিব আর সুফিয়ান, ওরা ২ জন, গেলো ঘাটে পৌঁছুনোর বন্দোবস্ত করতে। সি-ট্রাকের দুলুনি মাথায় গেঁথে গিয়েছিলো, আমরা চা খেয়ে ততক্ষণে সতেজ হয়ে নিলাম। দরদাম করে ২০০ টাকা প্রতিজন ধরে মোটরযান ঠিক করা হলো ৭ টা। স্থুল ও শুকনো মিলিয়ে ২ জন করে সবাই উঠে পরলো দ্রুত। আমরা ছুটে চলছি বাজার, ঘর, টং, প্রাইমারি স্কুল, সোনালীক্ষেত ফেলে সবুজ ফুঁড়ে ঝাঁঝালো হর্ন ছুড়তে-ছুড়তে৷ পেছনেরজন ব্যাগ কাঁধে আর মাঝেরজন ব্যাগ রাখে পায়ের উপর; এটাই নিয়ম মোটরযান ভ্রমণে। আমা দের এ যান ছুটে চলছে পিচ কামড়ে সবুজে। খানিক এগোতেই আমাদের চালকভাই দাঁড়িয়ে গেলেন। কানে গোজা হেডফোন সরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি সুপ্তি উঠে দাঁড়াচ্ছে রাস্তা থেকে। রাকিব দাঁড়িয়ে প্যান্ট ঝাড়তে সাহায্য করছে ওদের যানচালক ভাইয়ের। ততক্ষণে কিছু লোক জড়ো হয়ে গেছে চারপাশ ঘিরে। জিজ্ঞাস করে যা জানলাম- হঠাৎ একটা কুকুর রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে দৌড় দিতেই চাকার নিচে পড়ায় উল্টে যায় ওদের মোটরযান। আশেপাশে আহত কুকুরটাকে খুঁজছি ভালোভাবে চোখ মেলে। কিন্তু সে আহত বেচারার চিহ্ন পর্যন্ত নেই। বুঝলাম ততক্ষণে সে বেচারা আহত দেহ নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে বেঁচেছে। সুপ্তি-রাকিব জানালো তেমন ব্যথা পায় নি তাই আবারো ঠিকঠাক মতন ব্যাগগুলো কাঁধে-পায়ের উপর নিয়ে শুরু হলো যাত্রা। আমরা যানচালক ভাইকে বলেছিলাম সবার শেষে পৌঁছুতে ধীরে-সুস্থে; যাচ্ছিলেন সেভাবেই। হঠাৎ ই পিচের রাস্তা থেকে নেমে পড়লেন গ্রামের কাঁচা রাস্তায়, জানালেন সবার পেছনে থেকেও আগে-আগে চলে যাওয়া যাবে! গ্রামের মাটির রাস্তা; ইটের কংক্রিটের পথ ও ফুরোলো, এবড়োথেবড়ো মাটির পথ বেয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। পেছনে বসেছিলাম আমি, খুব ঝাঁকি খাচ্ছি যদিও; মাঝে-মাঝেই ঝাঁকিতে সিট থেকে আধা হাত উপরেও উঠে যাচ্ছি আবার মুহূর্তেই ধপাস করে সিটে এসে পড়ছি। যানচালক ভাই নিজের অভিজ্ঞতার ডালা মেলে ধরে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে দারুণ মৃদুভাবে বাড়িয়ে যাচ্ছেন গতি। চোখে পড়লো চারপাশের মানুষের জীবন। কেউ হাটে যাচ্ছেন, কেও বা শুটকি শুকোতে দিচ্ছেন রাস্তার এক কোনে, ন্যাংটো বাচ্চারা দল বেঁধে দিচ্ছে পুকুরে ঝাঁপ। যেতে-যেতে চালক ভাই জানালেন তার নানার বাড়ি এ গ্রামেই। সেটা অবশ্য ঠাহর হচ্ছিলোই। খানিক পর-পরই ছোট বাচ্চা-মা-চাচী বয়েসের মানুষেরা জিজ্ঞাসা করছিলেন কুশলাদী। মোটরযান নিয়ন্ত্রণে রেখেই উত্তর দিচ্ছিলেন স্মিত হেসে।
গিয়ারে ১ এ নামিয়ে মাটির রাস্তা থেকে একটানে উঁচু পিচের সড়কে উঠতেই বুঝলাম চলে এসেছি মোক্তারিয়া ঘাটের কাছাকাছি। কিছুদূর অগ্রসর হতেই মানুষের জটলাপূর্ণ ছোট এক বাজারে এসে থামলাম আমরা। ততক্ষণে বাকিরাও চলে এসেছে। আহ! ভাড়া মিটিয়ে দিতে-না-দিতেই মানুষ ও বিভিন্ন নিত্যব্যবহার্য মালামাল ভর্তি ট্রলার ছেড়ে গেলো নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশ্যে। কী আর করা! অপেক্ষার প্রহর শুরু; চা খাওয়া হলো আরেক ধাপ।
পরের নৌকা দ্বীপ ঘুরে এসে ঘাটে বাধলো। আমরা তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লাম টং দোকান থেকে কিন্তু নৌকোর কাছে যেতেই আমাদের অপেক্ষা করতে বললেন নৌকার মাঝি মামা। জানালেন, আগে উঠবে মহিষের পাল। বাচ্চাসহ মহিষকে রশি দিয়ে টেনে উঠানো শুরু হলো ট্রলার আকারের নৌকোর মাঝে। এরপর শুরু হলো নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সবার নৌকোয় নিজের স্থান দখলের প্রতিযোগিতা। তবে সেখানেও বিপত্তি; আমাদের সবাই নৌকোয় উঠতেই বলা হলো ছেলেরা নৌকোর এক মাথায় আর মেয়েরা অন্য মাথায়, আর শিশুবাচ্চা আর মালামাল এক সাথে নৌকোর মাঝের জায়গাটায় দাঁড়াতে হবে। এতে নাকি স্থানসংকুলান হয় বেশি। বড়ই অদ্ভুত সে দৃশ্য! তবে শেষদৃশ্যে আমরা আমাদের মতই সীমিত পরিসরে দাঁড়িয়ে-বসে যাত্রা শুরু করলাম নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ঘাটের উদ্দেশ্যে। ভাড়া নিলো ২০ টাকা করে, ১৫ মিনিটের নৌকা পারাপার।
নেমেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম সবাই। যাক- অবশেষে আমরা নিঝুম দ্বীপে পা রাখলাম। অনেক বছর ধরে কেবল শুনেই আসছিলাম এই দ্বীপের নিস্তব্ধতার, এবার আমাদের সুযোগ এসেছে সেই অভিজ্ঞতার সাক্ষী হবার৷এখান থেকেও আবার মোটরযানে উঠতে হবে, যেতে হবে নামার বাজারে; ওখানেই সব হোটেল, কটেজ এবং বাজার। উঠে পড়লাম সেই আগের বারের মতন ২ জন করে; ভাড়া নেবে প্রতিজন ৫০ টাকা। সরু রাস্তা উঠে গেলো সড়কে। পথের দু’ ধারে ধানি জমি, দূরের সৈকতে জ্বলজ্বল করছে পানিতে পড়া সূর্যের আলো। খানিকপরে রাস্তার দু’ধারে এসে পড়লো ঘন সংরক্ষিত বন। রাতে হরিণ নাকি হাঁটাচলা করে এ সড়কে। নিশ্চুপ চারপাশ; কেবল মোটরযান এবং হরেক প্রজাতির পাখপাখালির কলতান। এঁকে-বেঁকে রাস্তা যেন মিশে যাচ্ছিলো কুয়াশার ভেতর। কী মায়া-মায়া এক অনুভূতি চারপাশে!
নামার বাজারে নেমে হাতমুখ ধুয়ে প্রথমেই বসে গেলাম দুপুরের খাবার হোটেলে। এর ফাঁকে দুজন চলে গেলো কটেজ খুঁজতে। যদিও আগে থেকে বুকিং দিয়ে এলে বাজারে এসে সোজা চলে যাওয়া যায় বুকিংকৃত কটেজে; কিন্তু এখানে এসে কটেজ ঠিক করলে তুলনামূলক সুলভ মূল্যে রুম ভাড়া পাওয়া যায়। বন বিভাগের কটেজ, মসজিদ বোর্ডিং, হোটেল শাহীন ও ‘নিঝুম দ্বীপ রিভার্স এন্ড রিসোর্ট’ বা কেওড়া; এ সবগুলা থাকার জায়গা ঘুরে যা বোঝা গেলোঃ সবথেকে কম খরচে থাকার সুযোগ আছে হোটেল শাহীনে; তবে এর একমাত্র অসুবিধে হলো এটি একদম মূল বাজারের পাশেই। জেলা পরিষদের ‘ঈশিতা ইকো রিসোর্টের’ সামনে হাঁটাচলা এবং বারবিকিউএর জন্যে ছোট সুন্দর মাঠ আছে তবে আমরা বেছে নিলাম কেওড়াকেই যার নাম ‘নিঝুম দ্বীপ রিভার্স এন্ড রিসোর্ট’। এটিকে ভালো লাগার কারণ কয়েকটিঃ প্রথমত, এটি বাজার বা কোলাহল থেকে একটু দূরে, বাজার থেকে ৩ মিনিটের হাঁটাপথ। দ্বিতীয়ত, এটি মুলত বেশ বড় একটি পুকুরের চারপাশে ছোট ছোট ২ টি করে রুম নিয়ে তৈরি। চারপাশের পরিবেশ দারুণ, এবং এখান থেকে সোজা ক্ষেতের আইল ধরে চলে যাওয়া যায় সৈকতে।
আমরা এবার রুমে যে যার মতন ব্যাগ রেখে ক্লান্তি নিয়ে বসে পড়লাম গোছানো বিছানায়। সবাই গোসল সেরে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নিলো। বিকেল ৪ টার পরে সূর্যের তেজ মৃদু হয়ে এলেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম সৈকতের পথে। কটেজ থেকে সৈকতে যাবার সহজ উপায় হলো সূর্য ধরে সৈকতের পথে আগানো। সুর্য্যের এ আলোকে বলে ‘কনে দেখা আলো’। একটা লোককথা আছে এমনঃ শেষ বিকেলের এই মৃদু-উত্তাপহীন আলো যার মুখে এসে পরে তিনি হয়ে উঠেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যবান নারী বা পুরুষ; আর সে আলোয় স্নান করে হয়ে উঠেন শৈশবের পুত-পবিত্র একজন। সূর্যের এই আলো পানির ওপরে আঁছড়ে ভেসে উঠে স্থির উজ্জ্বল ঝলকানি আর বালিতে ছড়াতে থাকে চিকচিকে দ্যুতি।
বিকেলবেলায় সৈকতে থাকে বাচ্চা-কাচ্চাদের বিশাল সমাজ। ধান কাটা শেষে পরে থাকা খড় এবং কুড়িয়ে আনা প্লাস্টিকবর্জ্য ছোট-ছোট গাছের আড়ালে সবাই মিলে বসে ধরিয়ে দেয় আগুন; কাগজ, প্লাস্টিক বর্জ্য, খড় ও শুকনো গোবরের সহযোগে। কয়েকজন বাতাসের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়ায় যেন আগুন জ্বালায় বাধা না পায়। আমরা হাঁটছি খেজুর গাছ কতগুলাকে সামনে রেখে। সবাই পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে গল্প আড্ডায় মুখরিত আমাদের চারপাশের শূন্য সৈকত। এই নামার বাজার সৈকতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে কক্সবাজারের মতন বিপুলসংখ্যক পর্যটকের আনাগোনা নেই এবং সৈকত একদম ই শান্ত। জোয়ার আসে শেষ রাতে এবং বিকেলে ভাটা চলে। কেউ যদি নিশ্চিন্তে একান্তে নিজের সাথে কয়েকটা দিন সময় কাটাতে চান তাহলে তার জন্যে নিঝুম দ্বীপ হবে দারুণ উপভোগ্য।
সন্ধ্যা নামতেই বিশাল চাঁদ মেলে ধরলো তার কৃত্রিম আলোর জৌলুসের ঝাঁপি। পুরো সৈকতে ধীরে ধীরে যেভাবে গোধূলীর আলো নিভে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো, ঠিক সেভাবেই ধীরে ধীরে মায়া-মায়া জ্যোৎস্না স্নানে আমাদের ভিজিয়ে ছুটে চললো দিগন্ত বিস্তৃত। চাঁদ উঠতেই সৈকত হয়ে উঠলো চকচকে তরবারির ফলার মতন, যেন গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না মেলে ধরেছে তার যৌবন, ডাকছে ‘আয়-আয়!’
আড্ডা আর আপন মনে গান গাইতে-গাইতে এক সময় মনে হলো এবার ফেরা যাক। শেষ বিকেলে খেজুর গাছগুলোর নিচে যখন বসে পড়লাম ধপাস করে তখন নাড়া দিচ্ছিলো- আজ ভোরবেলাতেও আমরা ছিলাম জীর্ণ, জীবনের রঙহীন ছোট্ট এক শহরের এককোনে। আর আজকের বিকেল? সতেজ দূষিত ধোঁয়াহীন বাতাস, মায়াবী চকচকে স্বচ্ছ জ্যোৎস্না, নীড়ে ফেরা পাখির কলতান, বাদুর-শিয়াল সহ নিশাচর প্রাণীদের চলাচল এবং দূরের গ্রামগুলোর উঠোনের টিমটিম করে জ্বলে ওঠা ফিলামেন্ট বাল্বের গল্পে।
আমরা কটেজে ফেরার সময় পড়ে গেলাম ধাঁধাঁয়।
দৃশ্যমান দূরের গ্রামের উপস্থিতি বলতে নগন্য বাল্বের আলোই কেবল আমাদের গন্তব্যের দিক বলে দিচ্ছে। কিন্তু সেই গ্রামও তো ১৮০ ডিগ্রী বিস্তৃত। আমরা এবার সৈকত থেকে ফেরার পথ ধরলাম কিন্তু কটেজে যাবো কোন পথ ধরে! আরো সামনে হেঁটে কি ক্ষেতের আইল ধরে এগুবো? নাকি পিছিয়ে যাবো খানিকটা! এরপর আইলের পথ খুঁজবো? নাকি যেখানে আছি সেখান থেকে সোজা গ্রামের দিকে মুখ ফিরিয়ে হাঁটা শুরু করবো? সৈকতের বালুকাবেলা চকচক করছে জ্যোৎস্নায়; কিন্তু গ্রামগুলো? একদম নিগূঢ় অন্ধকারে ঠাসা। আমরা আরো খানিকটা এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ কনক বলে উঠলোঃ ‘চল এবার গ্রামের দিকে মুখ করে হাঁটা শুরু করি’। বলতে না বলতেই আমরাও চললাম একে-একে কনকের পিছুপিছু। কিন্তু খানিকটা এগিয়েই ও দাঁড়িয়ে গেলো। তাসমিয়াহ জিজ্ঞাস করলো- ‘কী হলো রে’ ! বললো- ‘সামনে সরু খাল, পার হবার রাস্তা তো দেখতাছি না’ । পুরো দল এবার গেলাম থেমে। আমরা এতক্ষণ অবশ্য পথ খোঁজা নিয়ে খুব বেশি কিছু ভাবছিলাম না, নিজেদের মতন হাঁটতে-হাঁটতে গল্প করছিলাম৷হঠাৎ গল্পের শেষের হাসিগুলো কেমন যেন মিলিয়ে গেলো বাতাসে! সবার চোখে তীক্ষ্ণ আতংক, সুচারু দৃষ্টিতে দেখছে চারপাশে। খুব চেষ্টাতেও কেউই মনে করতে পারলো না যে কটেজ থেকে সৈকতে আসার পথে এমন খাল দেখেছে কিনা কেও একজন! সুপ্তি বলে উঠলোঃ ‘চল খাল ধরে সামনে আগায়ে দেখি তো, কোনও কারণে হয়তো এই সরু প্রস্থের জলাধার চোখে পড়ে নাই কারো’। আমরা এবার হাঁটা শুরু করলাম খালের পাড় ধরে; কিছুটা পিছিয়ে এসে। হাঁটছি তো হাঁটছি। বেশ খানিকটা এমন হণ্টন কার্যাকলাপের শেষে আবারো মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো; সবার যে-যার মতন করে সামলে উঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু সাকিব একটা সময় দাঁড়িয়েই গেলো; বলেই ফেললোঃ ‘কই! এই খাল তো দেখি শেষ ই হচ্ছে না’ ! এত বড় খাল আমাদের পথের পাশেই ছিলো অথচ আমাদের কারোরই চোখেই পড়ে নাই, এ কি করে সম্ভব’! সবাই নিস্তব্ধ হয়ে গেলো আবারো।
দূরের গ্রামের গাছগুলো জ্যোৎস্নায় অন্ধকারকে যেন আরো গাঢ় করে তুলেছে। রাকিব এবার হিসেব কষতে বসলো, ভেবে বললো- ‘ঐ যে দূরের আলো, ঐটা হয়তো আমাদের কটেজের আলো হইতে পারে। কটেজ থেকে সামনে আগাতেই ওমন একটা গাছ কিন্তু ছিলো’। ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ সূচক কোন মন্তব্য করলো না কেউ; বোঝাই যাচ্ছিলো কেউই নিশ্চিত নয় এ ব্যাপারে। ঋতু খুব খুশি, ‘বলছে দারুণ এডভেঞ্চার হচ্ছে, ভাই’। হৈমী জানালো তার ভূতের ভয়। সুফিয়ান তার লম্বা শরীর নিয়ে হাঁটছে সবার শেষে চারপাশ দেখে। কনক এতক্ষণ ছিলো সবার সামনে-সামনে কিন্তু জানালো সে ও হতাশ। নিজে থেকেই তাই পিছিয়ে সবার সাথে স্বর মিলিয়ে খুচরো গল্পে মনোযোগ দিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করলো। জ্যোৎস্নার তীব্রতা বাড়ছেই প্রতি মুহূর্তে, সেই সাথে বেশ খানিকটা সময়ের জন্যে সবার কটেজে ফেরার তাড়াও যেন মিলিয়ে গেলো। এভাবে আধাঘন্টা হাঁটতে-হাঁটতে কখন যে সৈকতের কাছে চলে এলাম খেয়ালই করে নি’ কেও। জোয়ারের সময় হয়ে এসেছে, সবাই আলতো করে পা ভিজিয়ে নিলো। ঠান্ডা বাতাস, সাথে হিম শীতল ঠান্ডা পানির ঝাপ্টা সবার ভেতরটায় কেমন কাঁপুনী তুলে দিচ্ছিলো। যে যার মতন শীতের কাপড় আর চাদরে জেঁকে ধরলো নিজেকে। খানিকটা পর আবারো ক্ষেতের আইল খুঁজতে হাঁটা শুরু। হাঁটতে-হাঁটতে কিভাবে যেন ক্ষেত পেয়েই গেলাম সত্যি কিন্তু ঠিক কোন রাস্তায় উঠবো; কেও জানে না! কারণ ঘুটঘুটে অন্ধকারে গ্রামগুলো আচ্ছন্ন। মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে আমরা এগুচ্ছি ঠিক লাইন ধরে একজনের পর একজন। আইলগুলোও বেশ চিকন, বারংবার সবাই পড়ে যাচ্ছিলো আইল থেকে ক্ষেতে। আবারো উঠে হাঁটা শুরু করা লাইনে। একসময় সবাই পাশাপাশি এসে দাঁড়ালো; আবছা আলোয় দেখছে সামনে ঘেড়াও দেয়া জাল দিয়ে সবজি ক্ষেত আর অন্যপাশে খালের পানি। কী করবো ভাবতে না ভাবতেই জালের পাশে দিয়ে হাঁটা শুরু করলো পুরো ১৪ জনের দল। অদ্ভুতভাবে সবাই খেয়াল করলো পদযাত্রার গতি যতই বাড়ছে জাল দিয়ে জমি ঘেরাও করা অংশটুকুও যেন ততই বাড়ছে! গতির দ্রুততাতেই সম্ভবত মনের অজান্তের সবাই পাশাপাশি এক লাইন এসে দাঁড়ালো । সামনে দেখা যাচ্ছে উঁচু জমি, অল্পস্বল্প পানি জমে আছে এখানে-ওখানে। মুন্না সবার আগে লাফ দিয়ে জমা পানির পাশের শুকনো জায়গা দখল করে পরবর্তী শুকনা জায়গার উদ্দেশ্যে লাফ দিতে থাকলো; সাথে আমরাও ঠিক ঐ জায়গাগুলোতেই লাফ দিয়ে-দিয়ে গ্রামের দিকে এগোচ্ছি। এভাবে খানিকক্ষণ লম্ফ-ঝম্ফ শেষে সবাই মিলে আবিষ্কার করলাম গ্রামের সরু এক রাস্তা। দীর্ঘশ্বাস ফেলার ফুসরতও হলো যখন একজন লোক পেয়ে গেলাম, হেঁটে যাচ্ছিলেন তার বাড়ির পথে। জানালাম কেওড়া কটেজে এসেছি আমরা, বাজারের দিকে যেতে চাই; কোন পথে হাঁটে এগুবো? উনি জেনে নিলেন আমরা কোথা থেকে ঘুরতে এসেছি এবং জানালেন এই উঁচু-নিচু পানিবিস্তৃত জায়গাটায় নতুন কালভার্ট হবে, কাজ এগিয়ে চলছে। আমরা তখনও ঠিক নিশ্চিত না কটেজ বা বাজার থেকে আমরা কতদূরে! লোকটিকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বাজারের পথ ধরলাম সবাই এবং স্বস্তির এক মৃদু গুঞ্জনে গল্প শুরু হয়ে গেলো সবার ভেতর। অল্প কিছুটা হাঁটতেই পেয়ে গেলাম আমাদের কটেজ; বুঝলাম খুব অল্প দূরত্বেই সৈকতে ছিলাম আমরা, কটেজকে মাঝে রেখেই ঘুরছিলাম অর্ধবৃত্তাকার পথে। আমরা বাজারে চলে আসলাম, রাতের খাবার খেয়ে একবারে কটেজে এসে ঢুকবো বলে সিদ্ধান্ত নিলো সবাই। বাজারে চা, খেজুরের রসে ভেজানো গরম জিলাপি আর পিঁয়াজু খেতে খেতে শুরু হয়ে গেলো প্রায় ঘন্টা দেড়েকের আরেক আড্ডা।
কটেজে ফিরে সবাই একটু জিরিয়ে নিয়ে শুরু হলো রাতের আড্ডা; স্মৃতিচারণ, গান, গল্প আর কবিতা পাঠের আসর। সারাদিনের ক্লান্তিতে আড্ডায় যেখানে বসেছিলাম সেখানেই কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছি মনে নেই, ভোর পেরিয়ে সূর্যের উজ্জ্বল আলো মুখে এসে পরতেই সম্বিত ফিরে আসলো যেন। আমাদের নিঝুম দ্বীপের প্রথম রাত পেরিয়ে আজ শুরু হবে দ্বিতীয় দিন।
গন্তব্য নিঝুম দ্বীপঃ চৌধুরী খাল ও কবিরাজের চর (দ্বিতীয় পর্ব)
গন্তব্য নিঝুম দ্বীপঃ হরিণের সাথে সাক্ষাৎ ও মোহনার উত্তাল জলরাশি ডিঙ্গিয়ে বাড়ি ফেরা (শেষ পর্ব)
নিঝুম দ্বীপের আদ্যোপান্তঃ ভ্রমণ পরিকল্পনা, যাতায়াত, থাকার কটেজ, খাবার হোটেল ও দর্শনীয় স্থানসমূহ
ভাই, নিঝুম দ্বীপ এ তাহলে তিনবার ই যাওয়া হইছে আপনার!!!!!!
হ্যা রে। অন্তত আরো একবার ভিডিও করতে যাইতে হবে মনে হচ্ছে।