কটেজে ফিরে সবাই একটু জিরিয়ে নিয়ে শুরু হলো রাতের আড্ডা; স্মৃতিচারণ, গান, গল্প আর কবিতা পাঠের আসর। সারাদিনের ক্লান্তিতে আড্ডায় যেখানে বসেছিলাম সেখানেই কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছি মনে নেই, ভোর পেরিয়ে সূর্যের উজ্জ্বল আলো মুখে এসে পরতেই সম্বিত ফিরে আসলো যেন। আমাদের নিঝুম দ্বীপের প্রথম রাত পেরিয়ে আজ শুরু হবে দ্বিতীয় দিন।
আড়মোড়া ভেঙ্গে চোখ মেলতেই ঘড়ির কাঁটা জানিয়ে দিলো সকাল ৯ টা বেজে ৩ মিনিট। রাতে কটেজের আঙ্গিনায় আড্ডা, খাওয়াদাওয়া, কবিতা পাঠ ও পূর্বের ভ্রমণের স্মৃতিচারণ শেষে ভোর রাতে সবাই ঘুমুতে গিয়েছিলো। ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃরাশ শেষে সবাই এগিয়ে চললো বাজারে, উদ্দেশ্য নাস্তা করে বেরিয়ে পড়া। বন অফিস পিছু ফেলে ব্রিজ পেরিয়ে ছোট একটি বনে ঢুকে পড়লাম আমরা। মিনিট ১০ সামনে হাঁটতেই চলেও এলাম খালের ধারে। খালে জোয়ার আসা শুরু হয়েছে মাত্র। আমরা গতকালের ঠিক করে রাখা ট্রলারে উঠে পড়লাম সদলবলে। দু’পাশ ঘন সবুজ বন পিছু ফেলে মোহনার দিকে এগিয়ে চলছি। ট্রলারের শব্দ কিছুটা বিরক্তির কারণ হলেও যখন চোখে পড়তে শুরু করলো ঝাঁকে-ঝাঁকে বক বসে আছে বনের ধারের গাছগুলোতে, অচেনা পাখি তার সঙ্গীকে ডাকছে আপন মনে, বুনো মহিষের পাল গাছের ফাঁকে ফাঁকে খেয়ে যাচ্ছে ঘাস, আর খালের শান্ত জলে কাঁকড়া শিকার; সব মিলেয়ে দারুণ সময় কাটছিলো আমাদের। স্রোত ঠেলে ঢুকে পড়লাম চুয়াখালী বনের গহীন থেকে গহীনে। সবুজ যেন আমাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো বুনো গাঢ় সবুজে। মাঝেমাঝেই নৌকার গতি কমিয়ে দিয়ে মাঝি ভাই চারপাশে শান্ত নিস্তব্ধতায় কেমন যেন অচেনা ভয় নাড়া দেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছিলেন। খানিকক্ষণ পর নৌকো থামিয়ে দিলেন। প্রাণপণ চেষ্টাতেও বৈঠা দিয়ে ঠেলেও এগুনো যাচ্ছে না সামনে; বোঝা গেলো খালের পানি এখানে খুবই কম, নৌকার ছৈ গেড়ে গিয়েছে মাটিতে। খালের পাড়ের চিত্র আঁকলে দৃশ্যপটে ভেসে উঠবে- রাশি রাশি শ্বাসমূলে বিস্তৃত খালের পাড়। এ জায়গার মাটি তুলনামূলক নরম এবং ধুসর। ঘন সবুজে বিশুদ্ধ নিশ্বাস নেয়া যায় পাড় থেকে খানিকটা।
শ্বাসমূলঃ দিনেরবেলায় গাছের শ্বাসমূলগুলো ডুবে থাকে পানিতে কিংবা কাদায়। প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সংগ্রহে ভূগর্ভস্থ মূল উপরে উঠে আসে তার শ্বসনক্রিয়া নির্বিঘ্নে চালনা করার জন্যে। কারন এই ঊর্ধমূখী মূলের সম্মুখ অংশে থাকে শ্বাসছিদ্র ও ভেতরের অংশে থাকে বায়ুকুঠুরি।
শুরু হলো সবুজ ছুঁয়ে হাঁটা৷
নিঝুম দ্বীপের এই চুয়াখালী বনের নিজস্ব কিছু নিয়ম আছে। হরিণের পাল বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিংবা গল্পে মশগুল- এমন দৃশ্যের সাক্ষী হতে চাইলে প্রথমেই নিজেদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতে হবে; সাথে হাঁটার শব্দও হতে হবে ক্ষীণ। মাড়িয়ে যাবার শুকনা পাতার মর্মর ধ্বনিও যেন বনের নির্জনতায় বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। কারণ হরিণের শ্রবণ শক্তিও যেমন তীক্ষ্ণ তেমনি এর গতিও ক্ষীপ্র। মুহূর্তেই বাতাসে মিলিয়ে যায়!
কিছুদূর নিঃশব্দে হাঁটার চেষ্টা করতে করতে আমরা চলে আসলাম এক জলাধারের পাশে। এ জায়গাটা দারুণ। চারকোনা করে বড় পুকুর কাটা, হরিণের পাল এখানে আসে পানি খেতে, চারপাশে বড়বড় সব কড়ই গাছ; নিশ্চুপ একদম কেবল বাতাসে গাছের পাতার মর্মর শব্দ কানে আসে। পুকুরের পানিও সবুজ। পাড় বেশ উঁচু। যেকোনও একপাশে লুকিয়ে থেকে হরিণের পাল দেখার সবথেকে মোক্ষম সুযোগ এখানেই। এখনো চোখ বুজলে এ জায়গাটা স্মৃতির কুঠুরি থেকে সামনে চলে আসে। শখ জাগে পুকুরের পাশে যেকোন বড় একটি গাছের মগডালে পাটাতন বিছিয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ভরে নিয়ে আসি একটি রাত। বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে, গল্প আড্ডা দিয়ে বুঝে গেলাম হরিণের পাল নিজে থেকে এসে আমাদের দেখা দেবে না। খুব সম্ভবত তারা শোরগোল শুনে বুঝে গিয়েছে মনুষ্য প্রজাতি অবস্থান করছে চারপাশে। তাই আমরা আবার মাঝি মামার পিছুপিছু শুরু করলাম হাঁটা বনের গহীনে। মামা আবারও সতর্ক করে দিলেন যতটা নিঃশব্দে গহীনে যাওয়া যায় ততই সম্ভাবনা বেড়ে যাবে হরিণ দেখার।
আমরা এবার প্রবেশ করলাম বনের গভীরতম অংশে। গ্রামের মানুষ প্রতিদিন কাঁকড়া, গাছের শুকনো ডাল-পাতা সংগ্রহে, মহিষের পাল দেখাশোনা, মাছ ধরাসহ নানাকাজে বনের ভেতর হাঁটাচলায় তৈরি হয়ে গিয়েছে বনের ভেতরের এ রাস্তা। রাস্তাটি খুবই সরু, দু’ ধারে বহুসংখ্যক কাঁটা গাছে হাত-পা কেটে রক্তপাতের সম্ভাবনা থাকে। হাঁটাপথের যতদূর চোখ যায়- চোখে পড়ে অগণিত মলিন রঙের শ্বাসমূল; যেগুলোর উপরের অংশ খুবই তীক্ষ্ণ। শ্বাস মূলের ফাঁকে ফাঁকে মাটিতে সর্বত্র পড়ে আছে হরিণের পায়ের ছাপ ও তাদের মল। রাস্তার দু’ ধারের কাঁটা গাছের আঁচড়, নিজেদের মৃদু শব্দে কথা বলা এবং নিঃশব্দে হাঁটার প্রচেষ্টা; সবকিছু মিলিয়েই হরিণের সান্নিধ্য আমরা কোনওভাবেই পাচ্ছিলাম না। তবে মাঝে মাঝেই অনেক দূরে থেকে ভেসে আসছিলো হরিণের পালের চলাচলের শব্দ। কিন্তু এই ঘন বনে, লম্বা গাছের সারির ভেতর দিয়ে তীক্ষ্ণ শ্বাসমূলের আঘাত থেকে বেঁচে হরিণ দর্শন কপালে যেন জুটছিলোই না! আমরা হতাশ হচ্ছিলাম না বরং হরিণ দর্শন শেষেই কটেজে ফিরবো বলে পণ করে রেখেছিলো সবাই।
বনের এই নিঝুম পরিবেশই এ দ্বীপের নামের সার্থকতা বহন করে। সূর্য যেন তার সর্বোচ্চ অধ্যবসায়ের পরও একচ্ছত্র অধিপতি হতে পারে না এ বনে। ঝকঝকে উজ্জ্বল আলোর প্রতিযোগিতা সর্বক্ষণ চলতে থাকে ছায়ার সাথে; কিন্তু পেরে ওঠে না। তাই বনের মাটি ভেজা, সোঁদা গন্ধে মুহুর্মুহু চারপাশ। বাতাসে পাতা নড়ার শব্দ, বুনো পাখির কিচিরমিচির, খানিক অন্তর-অন্তর শেয়ালের হাঁক, দ্রুত ছুটে চলা হরিণের ক্ষুরের আঘাতে কেঁপে ওঠা অসার মাটির আন্দোলন ও আপন মনে বয়ে চলা খালে জোয়ারের শব্দ; পুরো প্রকৃতি যেন হিসেব কষে ঠিক করে নিচ্ছে, কোন শব্দ ঠিক কতটুকু গভীর হলে সবথেকে দারুণ স্বরবিতান তৈরি হবে!
আমাদের মাঝি মামা মাঝে মাঝেই থেমে কান খাড়া করে শুনছেন, কোথাও মাটি আঁচড়ে হরিণের পালের শব্দ কিংবা কোনও একটি হরিণের আনমনে পথ হাঁটা দেখা যায় কিনা। তাই মাঝে মাঝেই আমাদের থামিয়ে দিক পরিবর্তন করিয়ে, হাঁটা পথ ফেলে,শ্বাস মূলের সাগরের ভেতর দিয়ে হাঁটতে বলছেন। আমরাও খুব দেখে-শুনে ও চোখ-কান খোলা রেখে বুকের ভেতর মৃদু ধুকপুকানি নিয়ে হেঁটেই চলছি। সত্যি বলতে, নিঝুম দ্বীপের এ বনগুলো সবার ভেতর কয়েকটা বিষয় নাড়া দিবেই।
- অজানা আতঙ্ক
- একাকিত্ব
বনের গহীনে নেই ফোনের নেটওয়ার্ক, নেই কোন পথের নির্দেশনা। বোঝা যায় না, এভাবে গন্তব্যহীন হাঁটা দ্বীপের কোন অংশে নিয়ে যায় কিংবা আশেপাশেই কোন দুষ্ট লোক লুকিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে কিনা সব লুটে নেয়ার! তাই মনের গহীনে জীবন নাশের চাপা আতঙ্ক কাজ করে সাথে প্রকৃতির নিঝুমতা নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেয় নিজের সামনে। মেলে ধরে ভাবনার সীমাবদ্ধতা, সাহস ও মানসিক স্থিরতা, জাগতিক ব্যস্ততা কিংবা ক্লান্তি থেকে সাময়িক কার্যকর মুক্তি ও জীবনবোধ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা।
বনের ভেতরে গাছগুলো বেশ বড়োসড়ো। গাছের গাঢ় সতেজ পাতা শুষে নিতে চায় পুরোটা আলোকরশ্মি; তাই স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে থাকে মাটি, মাটির এই সোঁদা গন্ধ তাই নাকে লাগে প্রকটভাবে। হঠাৎ হাত উপরে উঠিয়ে মাঝি মামা সতর্ক করলেন। বোঝালেন- নিশ্চুপ হয়ে যেখানে যে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে যেতে। মামার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি গাছের আড়াল ফেলে ঘন গাছের আড়ালে। নিঃশব্দে আরেকটু এগিয়ে গেলেন সামনে। আমরাও গেলাম মামার পিছু-পিছু, যতটুকু নিঃশব্দে পা ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়। হঠাৎ থেমে হাত প্রসারিত করে সামনে দেখালেন। আমরা দেখলাম, ঝোপঝাড়ের ওপাশে একপাল হরিণ দাঁড়িয়ে আছে।
হরিণের দৃষ্টিশক্তি মাঝারি তবে শ্রবণশক্তি প্রবল এবং এরা লাজুক প্রকৃতির। তাই আমরাও যেমন দূর থেকে দেখছি তাদের, কান খাড়া করে তারাও শুনতে চেষ্টা করছে পাতা কিংবা যেকোনও কিছুর অস্বাভাবিক নড়াচড়া। মিনিট খানেক পর বুঝেও গেলো, কারণ ততক্ষণে আমরাও চেষ্টা করছি আরো একটু সান্নিধ্যে যেয়ে প্রাণ ভরে দেখতে, এবং দিলো এক ভোঁ-দৌড়।। মাঝি মামা আমাদের আবারো হাতের ইশারায় হাঁটতে বললেন চুপচাপ; আমরা সূঁচালো শ্বাসমূল থেকে বেঁচে হাঁটছি হরিণের দৌড়ের পথ ধরে। তবে এবার অতটা সচেতনভাবে নয় কারণ বুনো হরিণ দেখতে এসেছিলাম, হরিণের ডেরাও দেখে ফেলেছি অপ্রত্যাশিতভাবে। মৃদুস্বরে আলাপে মশগুল হয়ে হাঁটছি আমরা। হঠাৎ ই মামা আবারো সতর্ক করলেন আমাদের! আমরা থেমে গেলাম; দেখছি আরেক পাল হরিণ! তবে এ পালের সংখ্যায় হরিণ কম, ঘাস খাচ্ছে আপন মনে। আমরা খানিকটা এগিয়ে সামনে যেয়ে দেখবো; এমনটা ভাবতেই পালের সবাই একবার ঘাড় তুলে দেখেই দৌঁড়ে হারিয়ে গেলো সবুজের মাঝে!
এবার আমাদের ফেরার পালা। সবাই বলছিলো, এ বনে রাত কাটালে দারুণ হবে। পাখির ডাক, পশুর চলাচল দেখা, বনের ভোর দেখা, আড়মোড়া ভেঙ্গে নতুন দিনকে স্বাগত জানানো; একদম ‘লাইফ টাইম এক্সপেরিয়েনন্স।’ ফিরে এলাম পুকুরটার ধারে। এমন সবুজে বসে গল্প হলো, ‘বাঘের হালুম দৃশ্যে’ ছবি তোলা হলো । ইচিং-বিচিং খেলা শেষে উঠে পড়লাম সেই ট্রলারে। এবার খাল ধরে ফেরার পালা। ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের শেষটা যেন শুরুই হয়ে গেলো কটেজের এই পথ ধরা থেকে। হাতল ঘুরিয়ে ইঞ্জিন চালু করলো মুন্না। এবার মাঝি মামাকে বলে হালও ধরলো মুন্নাই। ও যে ট্রলার চালাতে জানতো, এটা আমরা জানতাম ই না!
খাল ফেলে নৌকো চলে আসলো মোহনায়। একপাশে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। নেমে গেলাম মাঠে। সিদ্ধান্ত হলো এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে তারপর ফিরবো কটেজে। মাঝি মামাকে পারিশ্রমিক বুঝিয়ে দিয়ে এবং ধন্যবাদ জানিয়ে হাসিমুখে বিদায় দিলাম সবাই। নরম ঘাস আর গাছের ছায়ায় আড্ডা দেয়া হলো কিছুটা সময়। বরফ পানি, বৌ-ছি খেলা হলো অনেকক্ষণ।
দৌড়ে ক্লান্ত প্রাণসব ক্ষুধাতুর চোখে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে জঙ্গল ধরে ফেরার পথ ধরলো।
জঙ্গল ফেলে খালের পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। সরু খাল, অপেক্ষা করছি কোনও একটি নৌকা এসে পার করে দেবে আমাদের। কয়েকটি নৌকা আসলো ঠিকই, কিন্তু পার করে দিতে অনুৎসাহ দেখতে পেলাম তাদের চোখে। দুঃখবোধ লাগছিলো যদিও এমন ব্যবহারে। আমি এর আগে দু’ বার এসেছে এই দ্বীপে। প্রতিবারই দেখেছি ছোট-ছোট ভিন্ন কিছু পরিবর্তন। প্রথম ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এসেছিলাম। এবার যে জিনিসটি বেশি চোখে পড়ছে তা হলোঃ অর্থের লেনদেন। এ মানুষগুলো ছিলো নির্ভেজাল, সরল ও সহযোগিতাপূর্ণ মানসিকতার। পুরো বছর জুড়েই ভ্রমন পিপাসু প্রচুর মানুষের গন্তব্য এ দ্বীপ। স্থানীয় মানুষদের সাথে তাদের সখ্যতা তৈরি না করে বরং অর্থের লেনদেনে সব বশে আনায় এ পরিবর্তন বলে আমার মনে হয়। তবে কিছুটা সময় অপেক্ষার পরই খাল পার করে দিলো বেঁধে রাখা আরেকটি নৌকা। বন বিভাগের অফিস ফেলে ঢুকে পড়া হলো সকালেই ঠিক রাখা খাবার হোটেলে। ইলিশ আর ছোটমাছ দিয়ে ভাত খেয়ে সোজা কটেজে ফিরে এলাম সবাই। গোসল সেরে কিছুটা গড়িয়ে নিলো নরম বিছানায়। সূর্য মাঝ আকাশ থেকে ঢলে পড়তেই যখন তেজ কমে গেলো আমরা বেরিয়ে পড়লাম সৈকতের উদ্দেশ্যে। গতকাল সন্ধ্যার পর ঠান্ডায় জমে গেয়েছিলাম সবাই। তাই ভালো করে চাদরে জড়িয়ে শুরু হলো হাঁটা। সৈকত ধরে আজও হাঁটছি খেজুর গাছ গুলোর দিকে। ছোটছোট বাচ্চাদের সাথে খানিকক্ষণ খেলা হলো। এরা খুবই মিশুক প্রকৃতির। দেখা হয়ে গেলো দুই চিত্রশিল্পীর সাথে। মনের সবটুকু রঙ ঢেলে একমনে এঁকে চলছেন নামারবাজার সৈকতের চিত্র।
রাত ৮ টার দিকে সৈকত থেকে ফেরার পালা শুরু, গন্তব্য বাজার। এবার আর গতকালের মতন ভুল না করে সোজা হেঁটে ঢুকে পড়লাম গ্রামের রাস্তায়। ঝিঁঝিঁ ডাকা গুমোট অন্ধকারের গ্রামের পথ আমাদের কালভার্ট পার করে নিয়ে এলো বাজারে। বাজারের এককোনে দেখি খেজুরের রসের জিলিপি ভাজছেন আর সাথে পেয়াজু। এক বসায় আমাদের বিল চলে আসলো ৩০০ টাকার কাছাকাছি। ঋতু বললো- ‘সে আজ খাওয়াবে’। টাকা পরিশোধ করে কটেজের দিকে যাওয়া শুরু হলো। এখানের প্রায় সব হোটেলগুলোতেই মহিষের দুধে বানানো দৈ বিক্রি করে। তিথি আপু খাওয়ালেন সবাইকে। হাঁটতে হাঁটতে সবাই বলছিলো, ‘নিঝুম দ্বীপে আসলাম আর খেজুরের রস না খেয়ে ফিরে যাব!’ গ্রামের রাস্তা থেকে কটেজের পথে ঢুকতেই নিচু একটা খেজুর গাছে চোখে পড়লো সবার; একটি প্লাস্টিকের বোতল ঝুলছে। কয়েকজন আড়চোখে আলাপ সেরে নিলো! আন্দাজ করা গেলো, রাতে যখন কুয়াশা ভেদ করে সৈকতে আবার যাওয়া হবে তখন চুরি করা হবে খেজুরের রস। যদিও মন থেকে কেও-ই সায় দিচ্ছিলো না, তা সবার চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট।
কটেজে ফিরেই শুরু হলো তুমুল আড্ডা। ঘড়ির কাটায় যখন রাত ১১ টা তখন সবাই বেরুলাম। আজ সৈকতে আমাদের বার-বি-কিউ এর আয়োজন। চাদর, সোয়েটারে জেঁকে বের হলাম সবাই। সৈকতের পাশের মাঠেই তাঁবু ফেলা হয়েছে। কাঠ পুড়িয়ে তৈরি হচ্ছে মুরগীর বার-বি-কিউ আর পরোটা, সাথে সস এবং সালাদ।
চাঁদ উঠলো। আজও ভরা পূর্ণিমা। সৈকতের সাদা বালি চিকচিক করছে। জোয়ারের শব্দে মুখরিত চারপাশ। আমরা গোল হয়ে বসে পড়লাম, যেন ঠান্ডায় জমে না যাই। ‘গানের কলি’ খেলা চলতে থাকলো সাথে। হাত-পা সব গুছিয়ে বসেছে সবাই। হৈমী আর কনক মিলে নিভে যাওয়া আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছে একটু পর-পরই। হঠাৎ রাকিব আর সাকিব বলে উঠলো, ‘পানিতে নামবে!’ আমরা ভেবেছি মজা করছে বোধহয়। মুহূর্তেই কয়েক স্তরের সব জামা খুলে দিলো ভোঁ-দৌড়। কুয়াশায় মিলিয়ে গেলো মুহূর্তেই। আমরা সবাই পরোটা আর বার-বি-কিউ করা মুরগী খেয়ে হাঁটা ধরলাম বালুর সমুদ্র পার হয়ে সৈকতের দিকে৷ সৈকতের পাড়ে দাঁড়াতেই কনকও চাদর-শার্ট খুলে নেমে গেলো পানিতে। আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে লাগলো প্রাণপণে। চেখে দেখার ভান করে খালি পায়ে পানিতে নামতেই দেখি পা জমে গেলো হিম ঠাণ্ডায়! কান ধরে সিদ্ধান্ত নিলাম, কোনওভাবেই এ পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করা যাবে না, অন্যথায় নিউমোনিয়া সুনিশ্চিত। এভাবেই কুয়াশা মোড়া সৈকত ধরে পূর্ণিমার অভাবনীয় মায়ায় চারপাশ অবলোকনেই কেটে গেলো অনেকটা সময়।
ঘড়ির কাঁটায় রাত তখন সাড়ে চারটা ছুঁইছুঁই। শীতের তীব্রতা আর আগামীকালের ঘরে ফেরার ক্লান্তি যেন এখনই জেঁকে বসেছে সবার মাঝে! ফিরতি পথ ধরা হলো এ দু’ দিনের স্মৃতিচারণ আলাপের মোড়কে।
গন্তব্য নিঝুম দ্বীপঃ হরিণের সাথে সাক্ষাৎ ও মোহনার উত্তাল জলরাশি ডিঙ্গিয়ে বাড়ি ফেরা (শেষ পর্ব)
নিঝুম দ্বীপের আদ্যোপান্তঃ ভ্রমণ পরিকল্পনা, যাতায়াত, থাকার কটেজ, খাবার হোটেল ও দর্শনীয় স্থানসমূহ
অসাধারণ😍😍।।পড়ছি আর মনে হচ্ছে আমিও বুঝি রওনা হলাম নিঝুম দ্বীপ এর উদ্দেশ্যে।। মনে হল সৈকত এ হাটছি,বনে হাঁটছি, হরিণ দেখছি।।
খুব ভালো লিখেছেন ভাইয়া।।। এমন আরও লেখা চাই নানান জায়গা ভ্রমন এর।।❤