‘Take nothing but memories, leave nothing but footprints’

গন্তব্য নিঝুম দ্বীপঃ হরিণের সাথে সাক্ষাৎ ও মোহনার উত্তাল জলরাশি ডিঙ্গিয়ে বাড়ি ফেরা (শেষ পর্ব)

দ্বিতীয় পর্বের পর…..

দরজায় ধাক্কা একের পর এক!

আমার অবশ্য ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো একটু আগেই; তবে তন্দ্রায় তখনও আচ্ছন্ন। শিশিরস্নাত সকালে কম্বলের উমে জড়িয়ে নিচ্ছিলাম বারংবার। কনক তখনো গভীর ঘুমে। আলতোভাবে কয়েকবার নাড়া দিয়ে ডেকে বললাম, ‘এ কনক, উডোছ না! কাকায় আসছে, দরজা খুলি দে।’ কনক ক্ষীণস্বরে ‘তুই যাস না!’ বলে অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে আবারো গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো। সীমাহীন বিরক্তি, আধ-ঘুম জাগরণের আবেশ, আর ক্লান্তিজোড়া চোখ ক্ষীন দৃষ্টিতে মেলে দরজা খুলতেই কটেজের ম্যানেজার বললেন, ‘নৌকা সোলি আইসে; আন্নেরা বেগ্গিন গোছাই তাত্তাই নাস্তা করি লন।’ ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে সবাই চোখে-মুখে এক অদৃশ্য বিষাদ নিয়ে যেন কটেজের ম্যানেজারকে চাবি বুঝিয়ে দিচ্ছিলো। এ ক’ দিনের ভাবলেশহীন নির্মল প্রকৃতিতে বিচরণ অভিজ্ঞতা, নেটওয়ার্কের বাইরে নিজের সাথে এ দুটো দিন কাটিয়ে আবার ফিরে যেতে হবে ক্লান্তির শহরে! আবারও শুরু হবে সেই গতানুগতিক একঘেয়ে জীবন, ব্যস্ততা, ক্লাস-সিটি, টিউশন আর দীর্ঘশ্বাস। সবুজে ছুটে যাওয়ার আকুতি নিয়ে আবারো শুরু হবে অফুরন্ত অপেক্ষার প্রহর গোনা।

। যেন আমাদের বিদায় জানাতেই এসেছে ।
। যেন আমাদের বিদায় জানাতেই এসেছে ।

চাবি হস্তান্তর শেষে আমরা সবে কটেজ থেকে বের হয়ে ছোট কালভার্ট পার হয়ে বাজারের দিকে এগোচ্ছি; হঠাৎ চোখে পড়লো, ঘন গাছের সারিতে জমা কুয়াশা ভেদ করে শ্লথ গতিতে এগিয়ে আসছে বেশ বড়সড় একটা হরিণ! নিজেদের চোখকে যেন বিশ্বাস করা যাচ্ছিলো না। খানিকক্ষণের জন্যে সময় যেন থেমে গেলো; অবাক চোখে অপেক্ষা করতে হলো বোধশক্তি ফিরে আসতে, সবার মনে একই প্রশ্নের উদ্রেক, ‘সত্যিই দেখছি তো!’ মনে হচ্ছিলো, যেন আমাদের বিদায় জানাতেই চলে এসেছে কটেজের কাছেই। পরে অবশ্য জানা গেলো, শীতের রাতে হরিণগুলো বনের পথ ধরে খাবার খুঁজতে গ্রামগুলোতে চলে আসে। হরিণপালের ২/১ টি হরিণ ভুল করে দল ফেলে ঢুকে পড়ে গ্রামে!

। পর্যটকদের এমন অরুচিকর আচরণ কাম্য নয় ।
। পর্যটকদের এমন অরুচিকর আচরণ কাম্য নয় ।

সবে নাস্তা খেতে বসেছি; জানা গেলো নৌকো ছাড়তে দেরি হবে, কারণ জোয়ার আসে নি তখনও। নাস্তা শেষে চা খেয়ে খাবার হোটেল দাদুর থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু হলো বন বিভাগের অফিসের দিকে। অফিসের পাশেই আছে সুউচ্চ এক ওয়াচ টাওয়ার। উপরে উঠতে শুরু করলাম কয়েকজন। এখান থেকে এ দ্বীপের অনেকটাই দেখা যায়। চোখ আটকে যায় বনের সবুজে কিংবা সৈকতে পরা কড়া সূর্যের ঝলকানিতে। ওয়াচ টাওয়ারের শীর্ষের দেয়ালে-ছাদে দেখলাম প্রচুর নাম লেখা, তারা এখানে এসেছিলেন এবং স্মৃতিস্বরুপ রেখে গিয়েছেন তাদের নাম এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের প্রিয় জনের নাম। এমন বিষয় নতুন নয়, ভ্রমণে বিভিন্ন পর্যটন জায়গাগুলোতে দেখতে পেয়েছি এমন সব চিত্রকলা। এ সময়গুলোতে ‘Chief Seattle’ এর একটি উক্তিই স্মৃতিরপটে ফিরে ফিরে আসে ‘Take nothing but memories, leave nothing but footprints’

‘Take nothing but memories, leave nothing but footprints’
‘Take nothing but memories, leave nothing but footprints’

সবাই ট্রলারে উঠে পড়লাম। অবিরাম গতিতে উঠানো হচ্ছে মাছ। একদল খালের পাড়ে মেপে পলিথিনে ভরছে চিড়িং মাছ, আরেকদল হাতে-হাতে পলিথিন গুলো সাজিয়ে যাচ্ছেন ট্রলারের পাটাতনে। জোয়ার আসার খানিক পরেই ট্রলার দুলে উঠলো। বোঝা গেলো মাটির উপর নোঙর করে রাখা ট্রলারের নিচে চলে এসেছে জোয়ারের পানি।

। খালের পাড়ে পলিথিনে মেপে রাখা চিড়িং মাছ ।
। খালের পাড়ে পলিথিনে মেপে রাখা চিড়িং মাছ ।

চেয়ারম্যান ঘাটের উদ্দেশ্যে ট্রলারের ছেড়ে যাবার কথা ছিলো ৯ টায়। কিন্তু খালে জোয়ারের পানি আসতে দেরি হওয়ায় ট্রলার ছাড়লো ঠিক সকাল সাড়ে ১০ টায়। তখনো সব মাছ পলিথিনে মোড়ানো শেষ হয় নি, পাড়েই রয়ে গিয়েছে প্রচুর। জানলাম, আজই এই মাছ চলে যাবে তমরুদ্দী ঘাট হয়ে ঢাকায়। তাই জেলে ভাইদের সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিলো- যতক্ষণ না খাল থেকে মোহনায় এসে ট্রলার ভিড়ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ছোট নৌকা কিংবা পাড় ধরে দৌড়ে ছুঁড়ে দিয়ে পলিথিনে ভরা মাছগুলো ট্রলারে উঠিয়ে দিতে। মিনিট ১৫ পর ট্রলার ছুটে চললো মোহনা পেরিয়ে হাতিয়ার উদ্দেশ্যে। দূরে সরে যাচ্ছে সবুজ গ্রাম, বিস্তৃত নরম ঘাসের প্রান্তর, জ্যোৎস্না ভরা সৈকত, বনের নির্জনতা ও সর্বোপরি আমাদের ফেলে আসা এ দু’ দিনের মায়া জন্মে যাওয়া স্মৃতি।

। ফেলে আসা মায়া জন্মে যাওয়া স্মৃতি ।
। ফেলে আসা মায়া জন্মে যাওয়া স্মৃতি ।

তমরুদ্দী ঘাট এসে কিছু মানুষ নেমে গেলেন; লঞ্চে করে তারা চলে যাবেন ঢাকার সদরঘাটে। বাকিরা সবাই জেঁকে বসলেন আরো সাড়ে ৩ ঘন্টার ক্লান্তি মাথার নিয়ে। ট্রলার আমাদের নামিয়ে দেবে চেয়ারম্যান ঘাট, এরপর আমরা সিএনজিতে চড়ে ফিরে যাবো সোনাপুর হয়ে মাইজদী।

। মোহনায় ঢুকে পড়লো ট্রলার ।
। মোহনায় ঢুকে পড়লো ট্রলার ।

তমরুদ্দী ঘাট থেকে ট্রলার ছাড়ার আড়াই ঘন্টা পর দারুণ এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম সবাই। মেঘনা নদীর হাড় কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস থেকে বাঁচতে চাদর ও মাফলারে নিজেদের জড়িয়ে স্থির হয়ে বসে আছি আমরা। এই বিরামহীন ট্রলারের দুলুনিতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে সবাই বারংবার, তবে ঠিক সুবিধে করতে পারছে না। ট্রলারের সামনের অংশে জায়গা করে নিয়েছে কয়েকজন; ততক্ষণে কুয়াশা জমা বাতাসে মানিয়ে নিয়েছে তারা। এমন একটা সময় ট্রলার প্রবেশ করলো মোহনায়।

 মোহনাঃ বড় নদীর স্রোতমুখ যা স্বাদুপানি, স্থলভূমি ও সমুদ্র দিয়ে বেষ্টিত।

বড় বড় ঢেউ যেন নিমন্ত্রণ জানালো আমাদের মোহনায় ঢুকে পড়ার সময়। নৌকো দুলে উঠতে শুরু করলো ভীষণভাবে। তীব্র স্রোতের তাণ্ডবে ট্রলার মুহূর্তেই উঠে যাচ্ছে অসীম পানে এবং পরমুহূর্তেই আছড়ে পড়ছিলো পানিতে! ভিজিয়ে দিচ্ছিলো আরাম করে জেঁকে বসা সবাইকে। ট্রলারের নিচের পাটাতনে পানি জমে যাচ্ছিলো অস্বাভাবিক হারে। এমন সময়ে নৌকার একজন মাঝি মামা আসলেন হাতে কোনও এক মসজিদের দান বাক্স নিয়ে। তীব্র স্বরে জানাচ্ছেন সবাইকে, ‘যে যার সামর্থ্য মতন দান করে যান; ইহকালের ধন-সম্পদ কিছুই সঙ্গে যাবে না, যাবে কেবল দান ও পুণ্যকাজ।’ এবং ঘুরে ঘুরে সবার কাছে যেতে লাগলেন। যে যার খুশি মতন নিজ হাতে বক্সে ফেলতে লাগলেন তাদের দান। খানিকক্ষণ পরেই স্রোতের তান্ডব কমে গেলো, সম্ভবত মোহনা ছাড়িয়ে ট্রলার আবারো ঢুকে পড়েছে মেঘনা নদীতে। এবং প্রায় সাথে সাথেই মাঝি মানুষটা দান বাক্স নিয়ে চলে গেলেন এবং বাক্স নিয়ে আসার আগের কাজে,নিজেদের রান্নার জন্যে সবজি-মাছ কাটা ও ধোয়া,মন দিলেন! আমরা হতবাক হয়ে সাক্ষী হয়ে রইলাম পুরোটা সময়ের!

। মাঝি মামার আপ্যায়নে দুপুরের ভাত খেলাম ট্রলারেই ।
। মাঝি মামার আপ্যায়নে দুপুরের ভাত খেলাম ট্রলারেই ।

মাঝি মামার আপ্যায়নে দুপুরের ভাত খেলাম ট্রলারেই। নিঝুম দ্বীপ থেকে আমাদের চেয়ারম্যান ঘাট পৌঁছুতে লেগে গেলো প্রায় ৫ ঘন্টার কাছাকাছি। সপ্তাহে মাত্র ১ বার এ ট্রলার ‘নিঝুম দ্বীপ থেকে চেয়ারম্যান ঘাট’ এবং ‘চেয়ারম্যান ঘাট থেকে নিঝুম দ্বীপ’ যাওয়া-আসা করে যেদিন এ দু’ জায়গায় হাট বসে। যখন ট্রলার থেকে বাজারে উঠে আসলাম ক্ষুধায় যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। বসে গেলাম খাবার হোটেলে। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত সাথে ইলিশ মাছ খেয়ে উঠে পড়লাম সিএনজিতে। সোনাপুর পেরোতেই প্রকৃতি যেন আমাদের বরণ করে নিলো ঝুম এক পশলা বৃষ্টি দিয়ে। দুপুরবেলার তাপদাহকে সাঙ্গ করে, সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে নোয়াখালীর মাইজদী শহর আমাদের স্বাগত জানালো নিবিড় প্রশান্তিতে।

 

পুনশ্চঃ

নিঝুম দ্বীপের মানুষগুলোর সাথে কথা বলে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ‘হরিণের মাংস খাওয়া’ কিংবা ‘হরিণ শিকার’ এ  দ্বীপের মানুষেরা ভালো চোখে দেখেন না এবং এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। তবে জানতে পারলাম, বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কিছু অসাধু শিকারী হরিণ শিকার করে। বন্য প্রাণীর উপর এমন নির্মম আচরণ বন্ধ হোক। এদেশে প্রশান্তি নেমে আসুক,মানুষ কিংবা পশু,সকল বাস্তুসংস্থানে।

 

 

 

‘নিঝুম দ্বীপ’ ভ্রমণ পরামর্শঃ

। নিঝুম দ্বীপে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ ।
। নিঝুম দ্বীপে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ ।

দ্বীপের মানুষগুলো সরল প্রকৃতির এবং পেশা হিসেবে অধিকাংশই বেছে নিয়েছেন মাছ ধরা ও চাষাবাদ। বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে জীবন ধারণ করেন কিছু মানুষ। এ দ্বীপে বড় ট্রলার বানানো হয়, যার বাজার মূল্য ৬০-৭০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। খাবার হোটেল গুলোতে কাঁকড়া খেতে পারেন। নিঝুম দ্বীপে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। তবে সন্ধ্যার পর থাকার হোটেল গুলোতে কয়েক ঘন্টার জন্যে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। শীতে খেজুরের রস পাওয়া যায় স্বল্প মুল্যে। সর্বোচ্চ মৎস আহরণ করা হয় এ দ্বীপের দক্ষিন অংশ থেকে। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের অবস্থান এ দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এ দ্বীপে বিশেষত চেওয়া, চিড়িং, ছোট চিংড়ি,বাটা, পোয়া, রিক্সা ও কোরাল মাছ পাওয়া যায়।

“নিঝুম দ্বীপের সৈকতগুলো লোকারণ্যহীন কোলাহল মুক্ত এবং এখানে অনুপস্থিত সমুদ্রের গর্জন”

চুয়াখালী বনের পুকুরটাতে হরিণের পাল পানি খেতে আসে সন্ধ্যায়। তাই হরিণ দেখতে চাইলে বিকেলেই পুকুর প্রাঙ্গনে চলে যাওয়া ভালো সিদ্ধান্ত। একান্তই বনে হরিণের দেখা না পেলে বন বিভাগের অফিস চত্ত্বরে ২ টি হরিণ শাবক দেখে মনের খায়েশ মিটিয়ে ফেলতে পারেন। বনে একা ভ্রমণের থেকে স্থানীয় একজনকে গাইড হিসেবে সাথে রেখে বনে বিচরণ করা বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ বনের গহীনে নেই নেটওয়ার্ক, নেই পথ-নির্দেশনা। এ দ্বীপের সৈকত ও বনাঞ্চল নিরাপদ। তবে সতর্কতা অনুসরণে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের শরণাপন্ন হতে পারেন। নিঝুম দ্বীপ মূল ভূ- খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, তাই যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বভাবতই দুর্বল। সেক্ষেত্রে ভ্রমণে মানসিক স্থিরতার উপর নির্ভর করাই শ্রেয়।

। বন বিভাগের অফিস চত্ত্বরে ২ টি হরিণ শাবক ।
। বন বিভাগের অফিস চত্ত্বরে ২ টি হরিণ শাবক ।

আতঙ্কের বিষয়ঃ দ্বীপ ভ্রমণে আসা স্বল্প সংখ্যক পর্যটকের আনাগোনাতেই নামার বাজার সমুদ্র সৈকতে প্রতি ৯ বর্গ ফুটে প্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছে ১০-১৫ টি।

। লোকারণ্যহীন সৈকত ।
। লোকারণ্যহীন সৈকত ।

গন্তব্য নিঝুম দ্বীপঃ নামার বাজার সৈকত (প্রথম পর্ব)

গন্তব্য নিঝুম দ্বীপঃ চৌধুরী খাল ও কবিরাজের চর (দ্বিতীয় পর্ব)

নিঝুম দ্বীপের আদ্যোপান্তঃ ভ্রমণ পরিকল্পনা, যাতায়াত, থাকার কটেজ, খাবার হোটেল ও দর্শনীয় স্থানসমূহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.