। কক্সবাজারে প্যারাসেইলিং ।

কক্সবাজারে প্যারাসেইলিং

‘উচ্চতা ভীতি’ কে জয় করে পাখির চোখে দেখে এলাম নীল জলরাশির অসীম সমুদ্র; সাথে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ পাহাড়ের সারি।

। Satellite Vision Sea Sports’ এর প্যারাসাইলিং পয়েন্ট ।
। Satellite Vision Sea Sports’ এর প্যারাসাইলিং পয়েন্ট ।

‘প্যারাসেইলিং’ বরাবরই আতংকের বিষয় আমার কাছে। বহু বছর অপেক্ষার পর এবারের জন্মদিনে ইচ্ছে ছিলো এ ভীতিকে বশে আনার। সাহস সঞ্চয় করে তাই ঘুরে দেখে এলাম ‘Satellite Vision Sea Sports’ এর প্যারাসেইলিং পয়েন্ট থেকে। প্যারাসেইলিং পয়েন্ট খ্যাত ‘দরিয়া নগরে’ চলে এলাম শেষ দুপুরে। মেঘলা দিন; সূর্যের তেজও তখন পড়তির দিকে। আকাশে আলো আর মেঘের খেলা চলছে পুরোদমে। মাঝে সাঝেই মেঘের বেড়াজালে আটকে থাকা সূর্য উঁকি দিচ্ছিলো আচমকা আকাশে চিকন আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে, যেন লুকোচুরিতে মগ্ন ছেলেবেলার দুই বন্ধু।

। লুকোচুরি খেলায় মগ্ন ছেলেবেলার দুই বন্ধু মেঘ ও সূর্য ।
। লুকোচুরি খেলায় মগ্ন ছেলেবেলার দুই বন্ধু মেঘ ও সূর্য ।

আমি এবং আমার বন্ধু ইনান প্যারাসেইলিং পয়েন্ট থেকে সৈকত ধরে খানিকটা এগিয়ে বিশাল বালির বস্তার উপর বসে উপভোগ করতে লাগলাম সে লুকোচুরি খেলা। সৈকতের আছড়ে পড়ছে সফেদ ঢেউ, ছোট লাল কাঁকড়ার দল সৈকতের এক গর্ত থেকে বেরিয়ে আরেক গর্তে লুকিয়ে যাচ্ছিলো দ্রুত গতিতে। ওদিকে খানিকটা দূর আকাশে ভেসে থাকা পর্যটক নেমে আসছিলেন মিনিট ৪-৫ এর পাখির চোখে অবিরত সৈকত ও সবুজ পাহাড়ের সারি এবং মেইন ড্রাইভেই অপরুপ দৃশ্য দেখে।

। 'Satellite Vision Sea Sports’ এর ইভেন্টসমূহ ও মূল্যতালিকা ।
। ‘Satellite Vision Sea Sports’ এর ইভেন্টসমূহ ও মূল্যতালিকা ।

প্যারাসেইল করে বেশ কয়েকজনের ওঠা-নামা দেখে- টাটকা সতেজ বাতাসে ঘন্টা খানেক সাহস সঞ্চয় করে আমরা পা বাড়ালাম আবারো প্যারাসেইল পয়েন্টের দিকে। কথা বলে এন্টি করে নিলাম নামের সিরিয়াল। গুনতে হলো জনপ্রতি ২০০০ টাকা করে। এখানে ২৫০০ টাকারও একটি প্যাকেজ রয়েছে।

। নাম নিবন্ধন করলাম ।
। নাম নিবন্ধন করলাম ।

আমি ভীত মানুষ, তাই ২ হাজার টাকার প্যাকেজেই নাম নিবন্ধন করলাম। দু’ জনের লাগলো ৪ হাজার টাকা।

আলাপে জানলাম, ২০০০ টাকার প্যাকেজে থাকবে সৈকত থেকে উড়িয়ে সমুদ্রের উপর মিনিট ৩-৪ এর ভ্রমণ শেষে আবারো সেই সৈকতেই নামিয়ে দেয়া এবং ২৫০০ টাকার প্যাকেজে রয়েছে সৈকত থেকে উড়িয়ে নিয়ে সমুদ্রে পা ভিজিয়ে আবারো উড়িয়ে সৈকতে নিরাপদে ল্যান্ডিং।

এরপর হেঁটে চলে আসলাম সৈকতে, যেখানে প্যারাসেইল উপভোগ করছেন সবাই। শূণ্যে ভেসে সৈকতে নেমে আসছিলেন যারা, প্যারাস্যুট খুলতে-খুলতে শুনছিলাম তাদের অভিজ্ঞতা। সবার চোখে-মুখেই দেখছিলাম তীব্র সুখের হাসি। এক বাক্যে সবাই বলছিলেন ‘লাইফ টাইম এক্সপেরিয়েন্স!’

আমার পালা আসলো।

। আংটা বেঁধে দিলেন প্যারাশুটের সাথে ।
। আংটা বেঁধে দিলেন প্যারাশুটের সাথে ।

লাইফ জ্যাকেট পড়িয়ে দিলেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আড়ামে বসে থাকা যায় এমন ফোমের আসন পড়িয়ে আংটা বেঁধে দিলেন প্যারাশুটের সাথে। এবার অপেক্ষা স্পিড বোট কখন স্টার্ট দেয় এবং বাতাসে প্যারাশুটটি উড়িয়ে নিয়ে যায় মাঝ সমুদ্রের দিকে।

বুকের ভেতরের ধুপ-পুকানী শুনছিলাম। কানের লতি গরম হয়ে যাচ্ছিলো অজানা আতংকে। এক্সাইটমেন্টে কয়েকবার শরীরের ভেতর থেকেও নাড়া দিয়ে উঠলো যেন! অবশেষে আসলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অসংখ্য ভাবনা, যেমনঃ সৈকত থেকে উড়ার সময় ভয় পাবো, তাই চোখ বন্ধ করে রাখবো কিংবা নিচের দিকে না তাকিয়ে বিস্তৃর্ণ নীল সমুদ্র দেখবো; এসব ভাবনা মুহুর্তেই মিলিয়ে গেলো!

কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই প্যারাশুট বাতাস ভর করে উড়িয়ে নিয়ে গেলো সমুদ্রের বুকে। স্পিড বোটের তীব্র আওয়াজ মৃদু থেকে ম্রীয়মান হতেই ভেসে উঠে যাচ্ছিলাম ৫ তলা থেকে ৩০ তলা সমান উচ্চতায়। দেখছি দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র ও পদচিহ্ন না পরা সতী সৈকত, মেরিন ড্রাইভের গাড়িগুলো যেন হঠাৎ ই খেলনা গাড়ি হয়ে ছুটতে শুরু করেছে দিক-বিদিক। দেখলাম, হিমছড়ির পাহাড়ের সারি। এ পাহাড়গুলো এতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত তা কখনও ভাবনাতেও আসে নি। এবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম নীল সমুদ্র। ঐ দূরে ডলফিনের দলের খেলা করা চোখে পড়লো! সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে খাপ খাইয়ে চলা মাছ ধরার মজবুত নৌকোগুলোকে দৈত্যাকার ঢেউ যেন আছড়ে এখনই ছুঁড়ে নিয়ে আসবে সৈকতে। সূর্যের তেজ গায়ে লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো যেন সূর্যের খুব কাছেই চলে এসেছি; যেন একই উচ্চতায়! মাছ ধরার ছোট-ছোট বাচ্চাদের মনে হচ্ছিলো কেবল এক-একটি কালো বিন্দু। আকাশে মেঘের খেলা দেখছিলাম যেন মেঘে ভেসেই। সূর্য-মেঘের এই স্বর্গীয় নিরন্তর খেলা থেকে মন বের হয়ে আসলো মুহুর্তেই প্যারাশুটের এক ঝাঁকিতেই। হুঁস ফিরে পেয়ে বুঝলাম, স্পিড বোটের অদম্য গতি ঢেউয়ের অসীম শক্তির সাথে যখন তাল রাখতে পারে নাঃ তখন এক-একটা ঝড়ো স্রোতের আঘাতের দোলুনী রশি বেয়ে প্যারাশুটে এসে লাগে। মাটি থেকে অত উপরে শূণ্যে ভেসে সে দোলুনী বুকের ভেতর ছ্যাত করে ওঠায়!

। দমকা বাতাসের তোড়ে প্যারাশুট উঠে যাচ্ছিলো দড়ির সর্বোচ্চ উচ্চতায় ।
। দমকা বাতাসের তোড়ে প্যারাশুট উঠে যাচ্ছিলো দড়ির সর্বোচ্চ উচ্চতায় ।

শূণ্যে নিজের পা ভাসা দেখতে দেখতেই বুঝলাম, এতক্ষণ যে গতিপথে যাচ্ছিলাম তার বিপরীত দিকে বোট ঘুরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। নিমিষেই দমকা বাতাসের তোড়ে প্যারাশুট উঠে যাচ্ছিলো দড়ির সর্বোচ্চ উচ্চতায়। ভীতির যোগাড় হতে শুরু করলো খানিকটা। কেমন যেন অজানা মায়ায় আচ্ছন্ন হলো চারপাশ। নীরবে চোখ বুজে আসলো। ভাসতে থাকলো জীবনের তীব্র সুখের স্মৃতিগুলো মনের দৃশ্যপটে। শূণ্যে ভাসতেই হেসে উঠেছিলাম সম্ভবত কয়েকবার মজার কোন দৃশ্য ভাসতে থাকাতে। শরীর হালকা হয়ে যাচ্ছিলো। দুঃখবোধও আক্রান্ত করলো স্মৃতিতে; যখন ভেসে এলো জীবনের সচেতনভাবে করা ভূলগুলো। আক্ষেপে নিমজ্জিত হলাম।

। হুঁশ ফিরে আসলো হ্যান্ড মাইকের আওয়াজে ।
। হুঁশ ফিরে আসলো হ্যান্ড মাইকের আওয়াজে ।

হুঁশ ফিরে আসলো হ্যান্ড মাইকের আওয়াজে৷ চোখ মেলে দেখলাম, ভাসতে ভাসতে চলে এসে পড়েছি প্যারাসেইল পয়েন্টের খুব কাছেই। মাইকে জানাচ্ছিলেন, লাল কাপড়ে বাঁধা দড়িটা টেনে ধরতে। ডান পাশে তাকাতেই পেয়েও গেলাম সে লাল কাপড়ে গিট বাঁধা দড়িটা। খানিকটা টেনে ধরতেই বুঝলাম, বেশ শক্ত হবে কাজটা। শূণ্যে শরীরের শক্তি যে উবে যায় তা ঠাহর হলো স্ব-চোক্ষে। যেন শরীরের সব শক্তি দিয়ে টেনে ধরতে হলো দড়িটা। টেনে ধরতেই অদ্ভুতভাবে অনুভূত হলোঃ এত সুন্দর করে উড়তে থাকা প্যারাশুটের মাঝ বরাবর থেকে আমি যেন হেলে যাচ্ছি একপাশে! প্যারাশুটের ছোট্ট কাপড়ের ফাঁকা ফাঁকা অংশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে অধিক পরিমাণ বাতাস এবং ভারসাম্য হারিয়ে ঢলে পড়ছে সৈকতের দিকে, যেন তীব্র বেগে আছড়ে পড়বে! ভয়ার্ত এক চেহারা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম দুর্যোগের। শকুন যেমন ক্ষীপ্র গতিতে শিকার দু’ পায়ের আংগুলে আঁকড়ে নিমিষেই হারিয়ে যায় শূণ্যে, তেমনি করে আমিও ক্ষীপ্র গতিতে আছড়ে পড়তে যাচ্ছি সৈকতে। দাঁড়িয়ে থাকা সৈকতের মানুষগুলোর মাথার উপর দিয়ে ভেসে প্যারাশুট যখনই সম্পূর্ণ ভারসাম্য হারিয়ে শেষ মুহুর্ত্বের তীব্রতায় আলিঙ্গন করবে সৈকতকে, ঠিক তখনই প্যারাসেইল কর্তৃপক্ষের অপেক্ষমান কয়েকজনের হাতের আলতো স্পর্শে,ক্রিকেট বলের মতন ক্যাচ ধরে, নেমে এলাম সৈকতে। নিরাপদে শেষ হলো প্যারাসেইলিং এর স্মৃতিবহ সাড়ে ৪ মিনিট।

 

কখন যাবেন

। দরিয়ানগর সৈকত ।
। দরিয়ানগর সৈকত ।

বৈরী আবহাওয়া, বাতাসের গতিপথ পরিবর্তন ও ঝড়ের সময় ব্যতীত বছরের যে কোন সময় ছুটির দিন সহ সপ্তাহব্যাপি প্যারাসেইলিং পরিচালনা কর্তৃপক্ষ এ ইভেন্ট পরিচালনা করেন।

প্যারাসেইলিং পয়েন্টে যাওয়ার উপায়ঃ

ঢাকা কিংবা দেশের যেকোন স্থান থেকে সরাসরি চলে আসুন কক্সবাজার ডলফিন পয়েন্টে। এখান থেকে রিজার্ভ/লোকাল অটো পাবেন, যা নিয়ে যাবে ‘দরিয়া নগর’ প্যারাসেইলিং পয়েন্টে। লোকালে ভাড়া নিবে ২৫ টাকা।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.